মোহাম্মদ আলী। একজন বাংলাদেশি শ্রমিক। দুবাই থেকে প্রতি মাসে হুন্ডির মাধ্যমে পরিবারকে টাকা পাঠাতেন। একবার তিনি ১ লাখ টাকা পাঠান একজন হুন্ডি ডিলারের মাধ্যমে। টাকা দেশে পৌঁছায়নি, আর সেই ডিলার পরবর্তীতে নিখোঁজ হয়ে যায়। কোনো কাগজপত্র না থাকায় তিনি আইনি সহায়তাও পাননি। পরে তিনি বুঝতে পারেন, বৈধ চ্যানেলে পাঠানোই সবচেয়ে নিরাপদ। বাংলাদেশের প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। প্রতি বছর তারা বৈধ পথে কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ভ‚মিকা রাখে। তবে এই বৈধ পন্থার বাইরে ‘হুন্ডি’ নামক অবৈধ প্রক্রিয়ার কারণে প্রবাসীরা নানা ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।
হুন্ডি কী?
হুন্ডি একটি অবৈধ অর্থ লেনদেন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে প্রবাসীরা টাকা পাঠান কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার না করে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা একটি অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রবাসীদের অর্থ দেশে পৌঁছে দেন, যার বিনিময়ে তারা সাধারণত তুলনামূলক ভালো বিনিময় হার বা দ্রæততা অফার করেন।
কেন প্রবাসীরা হুন্ডির আশ্রয় নেন?
১. বিনিময় হারের পার্থক্য: ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে বেশি টাকা পাওয়া যায় বলে অনেকেই এটি বেছে নেন।
২. সহজ প্রক্রিয়া: ব্যাংকিং প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অনেকেই হুন্ডিকে সহজ মনে করেন।
৩. অজ্ঞতা: অনেক প্রবাসী জানেন না যে হুন্ডি একটি অপরাধ এবং এর ফলে তারা আইনগত ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
৪. চাহিদা মেটানোর চাপ: দ্রুত টাকা পাঠানোর প্রয়োজন হলে অনেকে এই পন্থা বেছে নেন।
হুন্ডির ফলে কী ঝুঁকি তৈরি হয়?
১. আইনগত জটিলতা
হুন্ডি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। যেসব দেশে প্রবাসীরা কর্মরত, সেখানে হুন্ডির সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের জেল, জরিমানা বা দেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা থাকে।
২. অর্থ হারানোর ঝুঁকি
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে কোনো অফিসিয়াল রসিদ বা প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে কোনো জালিয়াতির শিকার হলে তা পুনরুদ্ধারের উপায় থাকে না।
৩. সন্ত্রাসে অর্থায়ন বা মানি লন্ডারিংয়ে ব্যবহার
হুন্ডির নেটওয়ার্ক প্রায়ই অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়, যেমন: মানবপাচার, অস্ত্র বা মাদক চোরাচালান ইত্যাদিতে। প্রবাসী না জেনেই এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন।
৪. জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব
বৈধ রেমিট্যান্স হ্রাস পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়, যা অর্থনীতিকে দুর্বল করে তোলে।
সরকার কী করছে?
বাংলাদেশ সরকার রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন: ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সে ২.৫% প্রণোদনা, অ্যাকাউন্ট খোলার সহজীকরণ, অনলাইন অ্যাপ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু।
অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা।
করণীয়
প্রবাসীদের উচিত: ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস বা প্রামাণ্য ডিজিটাল চ্যানেল ব্যবহার করে টাকা পাঠানো, হুন্ডির লোভনীয় অফার এড়িয়ে যাওয়া, সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও অন্যদের সচেতন করা, প্রয়োজনে দূতাবাস বা কনস্যুলেট থেকে তথ্য নেওয়া। হুন্ডি শুধু একটি অর্থনৈতিক অপরাধ নয়, এটি প্রবাসীদের জীবন, ভবিষ্যৎ ও দেশের অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ ফাঁদ। স্বল্পমেয়াদি সুবিধার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি নেওয়া কখনোই যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই সময় এসেছে প্রবাসীদের দায়িত্বশীল হওয়ার এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করার।
আপনার মতামত লিখুন :