ইস্টার দ্বীপের বিখ্যাত মোয়াই মূর্তিগুলো ক্রমশ সমুদ্রে বিলীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক ক্ষয়ের ফলে ঐতিহ্য হারানোর আশঙ্কায় রাপা নুই সম্প্রদায় এখন ঐতিহ্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
চিলি উপকূল থেকে ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপে প্রায় ১ হাজার মোয়াই মূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে। এটি ওয়াশিংটন ডিসির আকারের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এসব মূর্তির বেশিরভাগই আগ্নেয়গিরির ঢালে টাফ নামক নরম আগ্নেয় শিলা খোদাই করে তৈরি। টাফ স্বভাবতই ভঙ্গুর, ফলে বাতাস, বৃষ্টি ও সমুদ্রের লবণাক্ততার কারণে মূর্তিগুলো দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।
মোয়াই মূর্তিগুলো পলিনেশিয়ান পূর্বপুরুষদের প্রতীক হিসেবে খ্রিষ্টীয় একাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত হয়। মূর্তিগুলো দ্বীপের উপকূল বরাবর আহু নামক পাথরের প্ল্যাটফর্মে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালী ঢেউ এখন এসব প্ল্যাটফর্মকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।

ট্যুর গাইড মারিয়া টুকি বলেন, ‘আমার বাবা বলতেন, একদিন মোয়াই আবার সমুদ্রে ফিরে যাবে।’ তার বাবা ছিলেন একজন খ্যাতনামা মোয়াই ভাস্কর। এখন তার মতো অনেকেই নিজেদের চোখের সামনে মূর্তিগুলোর অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করছেন।
মোয়াইগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে রাসায়নিক আবরণ, থ্রিডি স্ক্যানিং, সমুদ্রপ্রাচীর নির্মাণ এবং ঐতিহ্যবাহী খোদাই পদ্ধতির পুনরুজ্জীবনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মাও হেনুয়া আদিবাসী গোষ্ঠী দ্বীপের জাতীয় উদ্যান পরিচালনার পাশাপাশি সংরক্ষণকাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইতালীয় বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তিতে আগুন ও আর্দ্রতা প্রতিরোধে রাসায়নিক চিকিৎসা শুরু হয়েছে। তবে অর্থায়ন ও আমদানি শুল্ক বড় চ্যালেঞ্জ।

ইতিহাসবিদরা জানান, মোয়াই তৈরি ও স্থাপনের শুরু থেকেই এগুলো ক্ষয়প্রবণ ছিল। পরিবেশগত পরিবর্তনের পাশাপাশি পাখি, গবাদি পশু এবং এমনকি পর্যটকদের অসাবধানতাও ক্ষতির জন্য দায়ী। ২০২০ সালে একটি ট্রাক দুর্ঘটনায় একটি মোয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৬ সালের ইউনেস্কো প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মোয়াই বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী স্থানে পরিণত হয়েছে।
সংস্কৃতি রক্ষায় কিছু স্থানীয় বিশ্বাস করেন, মূর্তিগুলোর জাদুঘরে স্থানান্তরই শ্রেয়। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে থাকা বিখ্যাত হোয়া হাকানানাই’আ মূর্তির প্রসঙ্গে তারা বলেন, নিরাপদ পরিবেশে এটি বিশ্ববাসীর কাছে রাপানুই সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, মূর্তিগুলো দ্বীপেই থাকা উচিত—এটাই তাদের প্রকৃত ‘জীবনচক্র’।

তবে রাপা নুইয়ের অনেকের কাছে মোয়াই শুধু ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক নিদর্শন নয়, বরং দ্বীপের পরিচয় ও টিকে থাকার প্রতীক। এগুলো প্রতিবছর লাখো পর্যটককে আকৃষ্ট করে, যা দ্বীপের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লদিও ক্রিস্টিনো-ফেরান্দোর মতে, এই স্মৃতিচিহ্নগুলোর ক্ষয় ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং এগুলোকে রক্ষা করা আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।
মাও হেনুয়া গ্রুপ চাইছে সংরক্ষণকে কেবল রক্ষণশীল প্রচেষ্টা হিসেবে না দেখে, নতুন খোদাই ও কারুশিল্পের মাধ্যমে ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখা হোক। টুকির বাবার খোদাই করা মূর্তিগুলো এখন চিলি, স্পেন ও জাপানের বিভিন্ন শহরে রাপানুই সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
টেপানো মার্টিন বলেন, ‘মোয়াই কেবল মূর্তি নয়, আমরা এগুলো সংরক্ষণ করি, কারণ এর ভেতরেই আছে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের অস্তিত্বের গল্প।’
আপনার মতামত লিখুন :