অবকাঠামো দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ সংকট ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতার বর্তমান বাস্তবতায় স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের উপযুক্ত সময় নয়। রপ্তানি বাণিজ্যে সক্ষমতা কমে রপ্তানি আয় কমবে, বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়বে, প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দেওয়া যাবে নাÑ এ রকম আরও অনেক কারণে কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই শুধু ইজ্জতের চিন্তা করে এখনই এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে দেশের জন্য আত্মঘাতী। মসৃণ ও টেকসই উত্তরণে আরও অন্তত ছয় বছর পিছিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য বিশ্লেষক, গবেষক ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এ-সংক্রান্ত এক সেমিনারে এ পরামর্শের পেছনে আরও বেশ কিছু যুক্তি ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন তারা। ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ: বাংলাদেশের সামনে কিছু বিকল্প’ শিরোনামের সেমিনার আয়োজন করেছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি)। রাজধানীর বনানীতে শেরাটন হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মসৃণ উত্তরণে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক এবং অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের কথা বলেন বক্তারা। এই প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক দল, সরকার, আমলা ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছে। অতীতে এ ধরনের সব উদ্যোগে শুধু আমলা এবং উন্নয়ন সহযোগীরাই ছিল বলে মন্তব্য করেন তারা। বলেন, এ কারণে বিগত দিনে এলডিসি উত্তরণে কার্যত কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি।
সভাপতির বক্তব্যে আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণকে আমরা সমর্থন করি, তবে যথাযথ প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় দরকার। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এর প্রভাব থাকবে অর্থনীতিতে, পরবর্তী সময়ে আসবে নতুন সরকারÑ সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বলেন, গত বছরের আগস্ট থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীদের আস্থায় প্রভাব পড়ছে।
আলোচনায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে এখন এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
এলডিসি থেকে উত্তরণে রপ্তানি বাণিজ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সেই পরিসংখ্যান তুল ধরে তিনি বলেন, জোটগত সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে বর্তমানে শুল্ক নেই। উত্তরণের পর শুল্ক হবে ১২ শতাংশ, কানাডায় হবে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ। জাপানে হবে ১২ দশমিক ৮ শতাংশের মতো। এতে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিনিময়ে লাভ কী দাঁড়াল? উৎপাদন ব্যবস্থায় গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো দুর্বলতার কথা তুলে ধরে এ কে আজাদ বলেন, ‘আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ চাই, তবে এটি হতে হবে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার পর।’ এ জন্য অন্যান্য বক্তার সঙ্গে তিনিও অন্তত ছয় বছর উত্তরণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, আজকের সেমিনারের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে একটি ড্রাফট তৈরি করে সব বাণিজ্য সংগঠনের সই নিয়ে তা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অফিসে পাঠাতে হবে। আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে এ দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা সংস্থা দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের (টিডব্লিউএন) লিগ্যাল অ্যাডভাইজার ও গবেষক সানিয়া রেইড স্মিথ। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ, তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার, বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় প্রমুখ।