বিনিয়োগকারীরা একসময় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) শেয়ার প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যে, এমনকি অনেক সময় অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিয়েও কিনেছিলেন। এখন সেই একই শেয়ার লেনদেন হচ্ছে এক টাকারও নিচে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) নতুন এক রেকর্ড গড়েছে। শেয়ারটির লেনদেন হয়েছে ইতিহাসে সর্বনি¤œ দরে, মাত্র প্রতি শেয়ার ৯০ পয়সা দরে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯ লাখ ৫৯ হাজার ১০১টি শেয়ার ৯০ পয়সা দরে লেনদেন হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন ভয়াবহভাবে নেমে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং তারল্য সংকট বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে একের পর এক খাতে শেয়ারদরের তীব্র পতনে। বহু শেয়ার এখন তাদের মূল মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে লেনদেন হচ্ছে।
বাজারের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১০৩টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড তাদের ১০ টাকা মূল মূল্যের নিচে লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে ৬৯টি ব্যাংক, বিমা, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টেক্সটাইল, খাদ্য, সার্ভিস ও ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন খাতের কোম্পানি, আর ৩৪টি মিউচুয়াল ফান্ড। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই ১০৩টির মধ্যে ৫৪টি কোম্পানি ও ফান্ড এখন ৫ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে যা বাজারে গভীর আস্থাহীনতার সংকেত দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিক অর্থনৈতিক চাপ, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ধারাবাহিক ক্ষতির কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন প্রবল হতাশায় ভুগছেন। অনেকেই ভবিষ্যৎ ক্ষতির আশঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন, নতুন বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
তারা আরও মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতি আস্থাহীনতা, আইনি সংস্কার নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দুর্বল উপস্থিতি এবং বিনিয়োগ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগÑ সব মিলিয়ে বাজারে আস্থার সংকট চরমে পৌঁছেছে। বাজার বিশ্লেষকরা দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় মালিকানাধীন। ১৩টি দেশি ও বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন। এর মধ্যে উচ্চ খেলাপি ঋণ ও টাকা ফেরত দিতে না পারা ২০টি প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করা হবে না জানতে চেয়ে নোটিশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। তবে চলতি মাসের শুরুতে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক ৯টি নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনের (এনবিএফআই) লাইসেন্স বাতিলের পরিকল্পনা করছে তীব্র আর্থিক সংকট এবং ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত না থাকার কারণে। এই খবরের পর থেকেই আর্থিক খাতের শেয়ারদর আরও নিচে নেমে যায়। এই ৯টি প্রতিষ্ঠান হলোÑ পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), এফএএস ফাইন্যান্স, অ্যাভিভা ফাইন্যান্স, ফেয়ারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং প্রিমিয়ার লিজিং।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই ৯টি প্রতিষ্ঠানে মোট ১৫,৩৭০ কোটি টাকা আমানত (ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক) রয়েছে। এর মধ্যে ৩,৫২৫ কোটি টাকা ছোট আমানতকারীদের, আর বাকি ১১,৮৪৫ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আমানত। ব্যক্তিগত আমানতকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রায় ১,৪০৫ কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে আটকে আছে। তবে পিপলস লিজিং কর্তৃপক্ষ ডিএসইকে জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি নির্দেশনা, সার্কুলার বা লাইসেন্স বাতিলসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাননি। তবুও, এই খবর তাদের আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সাবেক চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন তদারকির বাইরে ছিল। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান খারাপ হয়ে গেছে। এখন একীভূত বা মূলধন জোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি সঠিক বিধিবিধান দিয়ে খাতটিকে এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের আবাসন খাত, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ভূমিকা রাখতে পারে এই খাত। আর অর্থের উৎস হতে পারে বন্ড। এ জন্য আইনকানুন সময়োপযোগী করে দিতে হবে। মমিনুল ইসলাম আরও বলেন, পুরো খাত নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতের অর্থনীতিতে যেভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখছে, বাংলাদেশেও একই ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নিয়ে খাতটিকে এগিয়ে নিতে হবে।