ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫

ফের শীত আসছে এই বাংলায়

মির্জা হাসান মাহমুদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৫, ০১:২০ এএম

ষড়ঋতুর এই দেশের প্রতিটি ঋতুরই আছে নিজস্ব সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা। গ্রীষ্মের প্রখরতা কিংবা শরতের শুভ্রতা শেষে যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হতে শুরু করে, তখনই বোঝা যায় এবার আগমন ঘটবে শীতের। এ বছর হেমন্তের শুরুতেই শীতের আমেজ যেন ছুঁয়ে দিচ্ছে বাংলার জনপদ। উত্তরাঞ্চলে ভোরবেলা শিশিরভেজা ঘাসে সূর্যের আলো দেখে মনে হচ্ছে, শীত হয়তো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে। রংপুর, নওগাঁ, দিনাজপুরের পথে পথে ইতোমধ্যেই বইছে হালকা হিমেল হাওয়া। শীতের বার্তা বাহক পাখিটির ডানা ঝাপটানি এই বুঝি শুরু হলো। বাস্তুচ্যুত মেঘেরাও যেন উধাও। এতদিন দক্ষিণের কোলজুড়ে সদর্পে দাপাদাপি করত যে দখিনা পবন, সেও যেন দিক পরিবর্তন করে যোগ দিয়েছে উত্তরের দলে। ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে, পাতাগুলো শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার তালে তালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন বাংলাদেশে এবার একটু আগেভাগেই যেন চলে আসছে শীত।

হেমন্তেই শুরু শীতের আমেজ

পৌষ-মাঘ শীতের মূল মাস হলেও কার্তিক থেকেই ঠান্ডা ভাব অনুভূত হচ্ছে উত্তরাঞ্চলে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ বছর মৌসুমি বায়ুর প্রস্থান দ্রুত হওয়ায় তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে আগেভাগেই। ভোরে ঘাসের মাথায় জমছে শিশির, সূর্য উঠছে একটু দেরিতে, সন্ধ্যা নামছে দ্রুত। এ সময়ে প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে নরম রঙে। মাঠের ফসল ঘরে তোলার ব্যস্ততা বাড়বে কয়দিন পরেই। গাছপালার পাতায় পাতায় জমবে কুয়াশার ছোঁয়া। গাছিরা খেজুর গাছের যতœ নিতে শুরু করবেন, কারণ শীতের শুরুতেই মিষ্টি রসের স্বাদ পেতে হলে এখনই শুরু করতে হয় প্রস্তুতি। বাজারেও দেখা মিলছে আগাম শীতের ছোঁয়া। একদিকে শিম, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউসহ কিছু কিছু শীতের সবজি বাজারে এসেছে আগেভাগেই, অন্যদিকে পোশাকের দোকানগুলোতেও শুরু হয়েছে শীতকালীন নতুন কালেকশনের প্রস্তুতি।

পোশাকের প্রস্তুতি এখনই

শীত মানেই উষ্ণতার সঙ্গে স্টাইলের মেলবন্ধন। এই সময় পোশাকে বৈচিত্র্য আনা সহজ হয়, কারণ ঠান্ডা আবহাওয়া একাধিক স্তরের পোশাক পরার সুযোগ দেয়। এবার শীতেও সেই ধারাই বজায় থাকবে। তবে শীতের পোশাক এখন শুধু উষ্ণতায় সীমাবদ্ধ নেই, এখন তা ফ্যাশনেরও অনেক বড় অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিবারের মতো এবারও বাজারে আসছে নতুন নতুন ট্রেন্ড। এর মধ্যে ওভারসাইজ সোয়েটার, হালকা জ্যাকেট, নিটেড কার্ডিগান, স্কার্ফ, শাল আর হুডি জনপ্রিয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তরুণদের পছন্দের তালিকায় থাকবে হালকা কালারের জ্যাকেট ও ডেনিম, অন্যদিকে মেয়েরা বেছে নিতে পারে উষ্ণতার সঙ্গে রঙের মেলবন্ধন করা স্টাইলিশ পোশাক। শহরের ফ্যাশন হাউসগুলোও এখন ব্যস্ত নতুন কালেকশন সাজাতে। অনেকেই আগেভাগে কেনাকাটা সারছেন, কারণ শীতকাল চলে এলে পোশাকের দাম বেড়ে যায়। আবার ব্যাপক চাহিদার কারণে পছন্দের ডিজাইন মেলানোও কঠিন হয়ে পড়ে।

তবে শুধু নতুন পোশাকই নয়, পুরোনো শীতের পোশাক ব্যবহারের আগেও কিছু যতœ নেওয়া জরুরি। গত শীতের শেষে তুলে রাখা সোয়েটার, কোট কিংবা শাল ব্যবহার করার আগে রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে ধুয়ে ফেললে পোশাক থাকবে সতেজ; দুর্গন্ধও হবে না।

উষ্ণতায় ফ্যাশনের ছোঁয়া

শীত হলো ফ্যাশনের ঋতু। পার্কে বা কফিশপে বসে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তরুণরা মেলে ধরেন নিজেদের ব্যক্তিত্ব। কেউ পরেন উলের টুপি, কেউ মোটা স্কার্ফ, কেউ আবার বিদেশি স্টাইলে লম্বা ওভারকোটে সাজিয়ে নেন নিজেকে। শীতের ফ্যাশনে এখন রঙের ব্যবহারও বেড়েছে। কালো বা ধূসর রঙের সঙ্গে মিশছে অফহোয়াইট, বেজ, মেরুন, কিংবা হালকা সবুজ। হালকা অ্যাকসেসরিজ, যেমন- গ্লাভস, কানের টুপি বা স্নিকার্সেও আসছে নতুনত্ব। শীতের পোশাকের আরেকটি লক্ষণীয় দিক হলো কমফোর্ট থাকা। কাপড় যত নরম ও আরামদায়ক হবে, পরিধান তত স্বস্তিদায়ক মনে হবে।

তাই এখন অনেকেই সিনথেটিকের বদলে কটন মিশ্রিত উলের পোশাক বেছে নিচ্ছেন, যা দীর্ঘ সময় পরে থাকা যায় সহজেই।

জীবনযাপনে শীতের স্পর্শ

শীত মানে কিন্তু শুধু ফ্যাশন নয়! শীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা আনন্দ। অনেকে শীতের সকালে গরম চায়ের কাপে গল্পে মেতে উঠতে পছন্দ করেন। স্কুলে যাওয়া শিশুদের গলায় মাফলার তো নস্টালজিয়া। বিকেলে রোদ পোহাতে বসে পরিবারের হাসিমুখও শীতের একটি বিশেষ আনন্দ। এই সবকিছুতেই আছে এক ধরনের মধুর উষ্ণতা। যা আর কিছুদিন পর থেকেই পাওয়া যাবে। 

অনেকেই আবার এই সময়ে ছোটখাটো ভ্রমণের পরিকল্পনাও করেন। হিমেল হাওয়ার দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ট্যুর বা পিকনিক যেন শীতের বরণের অন্যতম উপায়। শীত বাড়তে বাড়তে শহরের রাস্তায় ফুচকা-চটপটির দোকানেও বাড়ে ভিড়।

একই সঙ্গে শীতের সময় ত্বকের যতœ নেওয়াও জরুরি হয়ে পরে। ঠান্ডা হাওয়ায় ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ে, তাই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং গরম কাপড় পরে থাকা খুব দরকার। অবশ্যই স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য দুটোই ঠিক রাখতে হবে সমানভাবে।

শীতের আগমন

মানেই প্রকৃতির রূপান্তর। এ সময় জীবনের গতি একটু ধীর হয়ে যায়। গরমের হাঁসফাঁস, বর্ষার ঝর-বাদলার পর শরত পেরিয়ে হেমন্ত এলেই মানুষের মুখে ভেসে অঠে একটুখানি স্বস্তির হাসি, কারণ হেমন্তের পরেই আসছে স্বস্তির শীত। এই সময়টাতে শহর হোক বা গ্রাম; সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়ে উষ্ণতা ও মমতার আবহ। শিশিরভেজা সকাল, বারান্দায় হালকা রোদ, খেত-খামারে নতুন ফসলের ঘ্রাণ, সাদাকালো-রঙিন পোশাকে সাজানো প্রিয়মুখ; সব মিলিয়ে শীত এসে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি মানুষের কত আপন, প্রকৃতি কত মায়াময়। হয়তো তাই প্রতিবার শীত এলেই মনে হয়, উষ্ণতায় জড়িয়ে নিতে ফের শীত আসছে এই বাংলায়।