দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিইসি বলেছেন, ‘নির্বাচনের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমস্যা হবে না বলে আমি মনে করি।’
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন মব ভায়োলেন্স, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ এবং নিজের নিরপেক্ষতার প্রশ্নেও জবাব দিয়েছেন। এ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে পারা না-পারার প্রশ্ন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রস্তুত হতে বলা হলেও নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। এ বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতির ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আমাদের ধারণা যে বর্তমানে যে টাইমফ্রেম বলা হচ্ছে, আইদার আর্লি ফেব্রুয়ারি বিফোর রমাদান, অর ইট মে বি সাম টাইম ইন দ্য ফার্স্ট হাফ অব এপ্রিল। হতে পারে, এপ্রিলের প্রথম দিকে হতে পারে। আমরা প্রথম থেকেই ডিসেম্বরকে টার্গেট করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কারণ তখন তিনি ডিসেম্বর টু জুন বলেছিলেন। এ জন্য আমরা ডিসেম্বরকে টার্গেট করে- ফ্রম ডে ওয়ান উই স্টার্টেড প্রিপেয়ারিং আওয়ারসেলভ।
তিনি আরও বলেন, যখন থেকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন, সম্ভবত গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর উনি যে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তখন আমি মৌলভীবাজারে ছিলাম। ওখানে বসেই আমি শুনলাম যে ‘আইদার ইট উইল বি ইন ডিসেম্বর, অর ইন জুন’Ñ এটা শুনলাম ওনার বক্তব্যের মধ্যে। এটা শোনার পরে প্রস্তুতি বাড়িয়ে দিলাম আমরা, ডিসেম্বরকে ধরে ব্যাক ক্যালকুলেশন করে। কারণ ইলেকশনের ডেট থেকে অন্তত দুই মাস আগে আমাদের শিডিউল ঘোষণা করতে হয় আমাদের আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অনুসারে। কারণ তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটের তারিখ পর্যন্ত যে কর্মকা-গুলো দরকার, তাতে অন এভারেজ দুই মাস না হলে পারা যায় না।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আমি এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ওনার সঙ্গে ফরমাল কোনো মিটিং হয়নি। দেখা হয়েছে ঈদের দিন বা এই ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে, ওইটুকুই। আমি মনে করলাম, ওনার সাথে ফরমাল একটা দেখা করা দরকার। এটা ছিল মূলত সৌজন্য সাক্ষাৎকার। কোনো এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনার জন্য আমি যাইনি। উনি হেড অব দ্য গভর্নমেন্ট, ওনার জন্য একটা নির্বাচন সামনে আছে, যে নির্বাচনটা আমাকে ডেলিভার করতে হবে, ইসিকে ডেলিভার করতে হবে। নির্বাচনটা আলোচনার মধ্যে এসে গেছে। শুধু উনি জানতে চেয়েছেন যে আমাদের প্রিপারেশনের অবস্থা কী, স্ট্যাটাসটা কী, আমরা কতদূর এগিয়েছি, প্রস্তুত কী রকম। উনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি ওনাকে ডিটেইল জানিয়েছি আমি কী কী করেছি, কী কী করতেছি, কী কী বাকি আছে বা আমাদের টাইমলাইনটা কী, কখন আমরা শেষ করতে পারব। আমাদের প্রস্তুতি সম্পর্কিত একটা ব্রিফ (ধারণা) ওনাকে (প্রধান উপদেষ্টাকে) আমি দিয়েছি। কারণ এটা ছিল মূলত সৌজন্য সাক্ষাৎকার।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বা বিএনপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ উঠেছে এনসিপির পক্ষ থেকে। নিজেদের নিরপেক্ষতার বিষয়ে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, যেদিন আমি শপথ নিয়েছি সেদিনই আমি কমিট করেছি, সুপ্রিম কোর্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছি। এমনকি আমার অফিসে যারা কাজ করেন, গত দোসরা মার্চ প্রথম রোজায় ভোটার দিবসে সবাইকে হাত তুলে শপথ করিয়েছি যে, আপনারা সবাই একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন, এমন ওয়াদা আমাকে দেন। পহেলা রমজান অধিকাংশ রোজাদার হাত তুলে শপথ করেছেন। সুতরাং ইসি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছে, ওই রাজনৈতিক বক্তব্য এগেইন দিতে পারে। সময়ের বিবর্তনে যখন দেখবে আমরা কাজ করছি নিরপেক্ষভাবে, আস্তে আস্তে যখন আমাদের কাজকর্ম আরও সম্প্রসারিত হবে, তারা রিঅ্যালাইজ করবে যে নাÑ এই নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আছে। তাদের আস্থা আমাদের ওপর আসবে।
বিএনপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট এমন অভিযোগের বিষয়ে সিইসি বলেন, আমি বিএনপির সদস্যও না, কোনো নেতাও না। কারো প্রতি আমাদের যে দুর্বলতা আছে, এটা বলতে পারে, পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট তো দিতেই পারে। আপনি তো এটা শুনছেন, অনেকে তো আমাকে জামায়াতও বলে। একেকজন একেকটা বলে। এগুলো পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট। আমি এগুলোকে সেভাবে দেখি। ওনারা বলতেই পারেন। ওনাদের তো বলার অধিকার আছে, বলবেই। আমাদের কাজকর্ম দেখে ওনারা একপর্যায়ে বুঝে যাবেন যে, এখান থেকে ন্যায়বিচার পাওয়া যায়। ...আমি সবার জন্য যেন সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে পারি, বিচারকের মতো করেই আমি এই কাজটা করতে চাই।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বিচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে সরকার, তার অর্থ কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না তারা? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, ওনাদের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। যদি বিচার শেষ হয়, যদি শাস্তি না দেওয়া হয়, নিষেধাজ্ঞা দেওয়া না হয়; সরকারের যে সিদ্ধান্ত সে অনুযায়ী তাদের রেজিস্ট্রেশন রাখাই তো মিনিংলেস হয়ে যায়। তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- করতে পারবে না। এ জন্য আমরাও রেজিস্ট্রেশন স্থগিত করে দিয়েছি।
বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে সিইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে স্থানীয় সরকারে ৬১ জেলা পরিষদ আছে। ৫৬৫টি আছে উপজেলা, পৌরসভা আছে ৩৩০, সিটি করপোরেশন আছে ১২টা, ইউনিয়ন কাউন্সিল আছে ৪৫৯২টা। এই ইলেকশনগুলোতে খুব সহিংসতা হয়। এ জন্য এই ভোটগুলো ধাপে ধাপে করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সব কিছু মবিলাইজ করতে সুবিধা হয়। পাঁচ, ছয় বা সাত ধাপে এগুলো করা হয়। ধাপে ধাপে করতে গেলে দেখা যায় যে এটা দশ মাস থেকে এক বছর সময় লাগে কমপক্ষে। এখন আমাদের জাতীয় নির্বাচনের আগে তো সেই সময় নাই। স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা ভাবছি না। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখেই কাজ করছি।
আপনার মতামত লিখুন :