সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৫, ১১:০৭ পিএম

অপরাধীদের আখড়া মিটফোর্ড

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৫, ১১:০৭ পিএম

অপরাধীদের আখড়া মিটফোর্ড

বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ব্যবসা থাকায় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা। চোর ও দালাল ছাড়াও সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী এবং মাদক কারবারিদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের ভেতরের এক নম্বর ও তিন নম্বর ভবনের ভেতরেই দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে ওই এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করে আসছে একটি চক্র। 
শুধু তা-ই নয়, ওই দুই ভবনের ছাদে বসেই ইয়াবাসহ মাদক সিন্ডিকেটের নিয়মিত আড্ডা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের পরিকল্পনা করা হয়। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক সোহাগ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, রিপন, সাজ্জাদসহ অনেকে। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে শতাধিক সদস্য। সন্ধ্যার পরপরই হাসপাতালের ছাদে চলে এদের আড্ডা। রাত যত গভীর হয় এই চক্রের অপতৎপরতা আরও বাড়তে থাকে। এসব কারণে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। গত বুধবার হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী সোহাগকে প্রকাশ্যে হত্যার পর থেকে তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। এ কারণে মেডিকেল চত্বরে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে কর্মবিরতি ও ক্লাস বর্জন করেছেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান, মেডিকেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির স্টাফদের বখে যাওয়া সন্তানদের সঙ্গে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের একটি সখ্য রয়েছে। এই সুযোগে কর্তৃপক্ষের অগোচরে নিরাপদ জায়গা ভেবে অপরাধীরা মেডিকেলের ছাদে মাদকের কারবার করে আসছে। 
তিনি বলেন, মহিনের মা-বাবা মিটফোর্ড হাসপাতালের স্টাফ। আওয়ামী লীগ আমলে মহিনকে শেল্টার দিত হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন বাবুল। এ ছাড়া হাজী সেলিমের হয়েও কাজ করত মহিন। এরপর গত বছরের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টে বর্তমানে যাদের দাপট তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে।  
জানা গেছে, হাসপাতালটিতে রয়েছে চোরের উৎপাত। প্রতিদিন হাসপাতালে তিন থেকে চার হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ রোগী কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরের রোগী। এদের মধ্যে বেশির ভাগই গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনে এবং পরবর্তী সময়ে ডাক্তার দেখাতেও এ লাইন ধরে থাকেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চোররা রোগীদের ব্যাগ ও পকেট থেকে কৌশলে টাকা নিয়ে নেয়। জিনজিরা এলাকার বাসিন্দা ফুটপাতে ফল বিক্রেতা সুমন জানান, বৃহস্পতিবার সকালে তার মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যান তিনি। মেয়ের পেটে ব্যথা থাকায় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনি। পরে ডাক্তার দেখালে চিকিৎসা আলট্রাসনোগ্রাম ও বুকের এক্স-রে করতে বলেন। পরে কাউন্টারে টাকা দিতে গেলে পকেটে হাত দিয়ে দেখি সঙ্গে থাকা দুই হাজার টাকা নেই।
অন্যদিকে মিটফোর্ড হাসপাতাল দালালের দখলে। দেড় থেকে দুইশ দালাল আলাদাভাবে রোগীদের ফুসলিয়ে হাসপাতালের পাশে থাকা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। ওইসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তাররাই নিয়মিত রোগী দেখেন। চিহ্নিত দালালরা নিয়মিত দালালি করছেন। এসব দালালকে নিয়ন্ত্রণ করে হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার বেলাল। সে নিজেই একটি প্রাইভেট হাসপাতালের পার্টনার। দালালদের সরদার সাজু জানান, আগে হাসপাতালের কর্মচারী নেতার কথামতো আল-আরাফাত হাসপাতালে রোগী দিতাম। এখন ওয়ার্ড মাস্টার বেলালের প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স লাইফে রোগী পাঠাতে হয়।
একাধিক রোগী এ প্রতিবেদককে জানান, ওইসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসার নামে গলা কাটে। রোগী ভালো তো হয়ই না, উল্টো রোগীকে নানা সমস্যায় ভুগতে হয়।
ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য : মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে বেড়িবাঁধ রোড। এ রোড দিয়ে লাখ লাখ মানুষ চলাফেরা করে। রাতে কিংবা দিনে সব সময়ই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ। এসব ছিনতাইকারী ছিনতাইয়ের পর মিটফোর্ড হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। আর ছিনতাইকারীদের সাপোর্ট দেয় আওয়ামী লীগের আমলে হাসপাতালের কর্মচারী নেতা মোজাফফর হোসেন বাবুল। এখন তাদের সহযোগিতা করে মহিন, রিপন, সিএনজি রনি ও সাজ্জাদ নামের যুবদল পরিচয়দানকারী।
জানা গেছে, এলাকার সব চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের আড্ডাখানা মিটফোর্ড হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ভবন ও নতুন ভবনের ছাদ। ওখানে তারা নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবন করে আসছে। কিছুদিন আগে এ ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক ছাদের চাবি নিয়ে নেন। পরে তারা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিয়ে আসছে। তবে মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যার পর দুর্বৃত্তরা গাঢাকা দেওয়ায় এখন সেই আড্ডা আর নেই। 
এক কর্মচারী জানান, এই সিন্ডিকেটে রয়েছে সোহাগের অন্যতম আসামি মহিন, সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার তারেক, সিএনজি রনিসহ শতাধিক সদস্য। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা ছাদে অবস্থান করে মাদক, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- পরিচালনা করত। 
এদিকে নিরাপত্তার দাবিতে এবং এসব অপরাধীকে রুখতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা গত শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদকসেবীদের রুখতে মিটফোর্ডের আশপাশের সব অবৈধ দোকানপাট বন্ধ ও পেছনের সব গেট বন্ধ না করলে শাটডাউন ঘোষণার দাবি করলে তা দীর্ঘক্ষণ পর মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের জানান, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা নানা অপরাধ ও পেছনের গেট দিয়ে বহিরাগতদের অহেতুক আনাগোনা বন্ধের দাবি জানালে সেগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। 
নিরাপত্তার দাবিতে ইন্টার্নদের কর্মবিরতি, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে কর্মবিরতি ও ক্লাস বর্জন করেছেন। গতকাল রোববার সকাল থেকে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে যান এবং মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে অনুপস্থিত থেকে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ উদ্দিন নাদিম বলেন, আমাদের ক্যাম্পাস এমন একটা জায়গা, যেখানে বহিরাগত আর শিক্ষার্থীদের আলাদা করা যায় না। প্রচুর বাইরের লোক এখানে ঘোরাফেরা করে। নিরাপত্তার দাবি নিয়ে আমরা অধ্যক্ষের কাছে গেলেও কোনো আশ্বাস পাইনি।
অপরদিকে, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সংগঠন ইন্টার্ন ডক্টরস সোসাইটির (আইডিএস) সভাপতি ডা. ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আট দফা দাবি জানিয়েছি। হাসপাতালের পরিচালক কিছু দাবি পূরণ করেছেন, যেমন হাসপাতালের সামনের অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ। বাকি দাবি পূরণে আজ (গতকাল) আমরা কর্মবিরতি পালন করছি। সন্ধ্যায় বৈঠকে পরবর্তী কর্মসূচি জানানো হবে।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আট দফা দাবির মধ্যে রয়েছেÑ হাসপাতাল চত্বরে ২৪ ঘণ্টা সশস্ত্র আনসার মোতায়েন, প্রতিটি ফটকে আনসার সদস্য মোতায়েন, নারী আনসারসংখ্যা বৃদ্ধি, লেডি ডক্টরস হোস্টেলে আনসার নিযুক্তি, মিটফোর্ড হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে পুলিশ বক্স স্থাপন, অনিয়ম দূরীকরণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বর্তমান আনসার সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, আনসারদের সপ্তাহে ৭ দিন, দিনে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি বাধ্যতামূলক করা। কলেজ অধ্যক্ষ ডা. মো. মাজহারুল শাহীন বলেন, শিক্ষার্থীরা আজ (গতকাল) ক্লাসে আসেনি, তারা ক্লাস বর্জন করেছে। তবে শাটডাউন ঘোষণা করেছে কি নাÑ এ বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেনি।
গত ৯ জুলাই বিকেলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে ব্যবসায়ী লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশব্যাপী তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষাপটে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা চেয়ে কর্মসূচি শুরু করেন। বর্তমানে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ২৩০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক কর্মবিরতিতে রয়েছেন। ফলে হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
এর আগে এক স্মারকলিপিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা জানান, গত ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতরে আনসার ক্যাম্পের সামনে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকা-ে তারা মর্মাহত ও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারা এই মনুষ্যত্বহীন ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন, হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য তারা বেশ কিছু সুস্পষ্ট দাবি উত্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে, কার্যকর আনসার মোতায়েন, সশস্ত্র আনসার নিয়োগ এবং প্রত্যেক ফটকে আনসার সদস্য রাখার ব্যবস্থা। 

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!