সারা দেশে খুন, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, অপহরণ, নারী নির্যাতন, মব সহিংসতা, মাদক চোরাচালানসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় গত রোববার মধ্যরাত থেকে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পুলিশের বিশেষ শাখার গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী দুই হাজার ৩১ জনের তালিকায় থাকাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারে পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ এ অভিযানের খবরে গা ঢাকা দিচ্ছে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীরা।
তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, কাঁচাবাজার, ফুটপাত, নৌপথ, সড়ক ও মহাসড়কে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতরা। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে এ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
দিন দিন অপরাধীরা হয়ে উঠছে বেপরোয়া। একের পর এক নৃশংস ঘটনা জনমনে ভীতি সঞ্চার করেছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লোমহর্ষক হত্যাকা-, নারী ও শিশু নিপীড়ন এবং দলবদ্ধ হামলায় প্রশ্নবিদ্ধ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িতদের নতুন তালিকা করে চিরুনি অভিযানে নেমেছে পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনী। গত রোববার রাত থেকে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এ অভিযানে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ এবং নারী ও শিশু নিপীড়নকারীদের গ্রেপ্তার অগ্রাধিকার পাবে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সব ধরনের অপরাধীর নতুনভাবে তালিকা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হবে না। জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার এবং দেশজুড়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ‘জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন সেন্টার’ রয়েছে। সেখান থেকে অভিযান সমন্বয় করা হবে। গত বছরের জুলাই আগস্টের তীব্র গণআন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ঘটনা বেড়ে যায়। দেশে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সাধারন মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ এবং থানার অপারেশনাল কার্যক্রমে ধীরগতির সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ অপরাধমূলক কাজ শুরু করে। পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল ইসলাম বলেন, যে বিশেষ অভিযানটি আগে থেকে চলমান, সেখানে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তির অপতৎপরতা রোধ করাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখন যে অভিযান চলবে, সেখানে চাঁদাবাজ-দখলবাজদের আইনের আওতায় আনা হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ চিরুনি অভিযান সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা ও নির্বাচনপূর্ব স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পুলিশ সারা দেশে কাজ করছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকা- বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। নিজ নিজ জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশকে সদা প্রস্তুত থাকতে এবং মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদেরও সজাগ থাকতে বলা হয়। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের তালিকাসহ অপরাপর অপরাধীদের তালিকা আপডেট হতে থাকে। কখনো এ তালিকায় সংখ্যা বাড়ে, কখনো কমে। অভিযানে ধরা পড়ার পর তালিকায় সংখ্যা কমে যায়। অপরাধের হারও কমে তখন। আবার বাড়লে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবেই অভিযান চালায়, আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নিজ নিজ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ওসিরা তাদের অধিক্ষেত্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।
গত বুধবার পুরান ঢাকায় মিটফোর্ড এলাকায় লাল চাঁদ সোহাগ নামে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গত শুক্রবার খুলনায় যুবদল নেতা মাহাবুবুর রহমান মোল্লাকে খুনের পর পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয় এক ইমামকে। পল্লবীতে চাঁদা না পেয়ে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে হামলা ও গুলি চালানো হয়। শ্যামলীতে এক যুবকের মানিব্যাগ ও ব্যাগ, মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেওয়ার সময় তার পরনের পোশাক, জুতাও অস্ত্রের মুখে খুলে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, দখল, হামলার নানা ঘটনা সামনে আসছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন মাসে সারা দেশে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৪৪টি, মে মাসে ৩৪১, এপ্রিল ৩৩৬, মার্চে ৩১৬, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০ ও জানুয়ারিতে ২৯৪। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, কিছু মামলা রুজু হয়েছে, যা পূর্ববর্তী মাসের ঘটনার। এ ছাড়া জুনে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা ১৯৩৩, মে মাসে ২০৮৭, এপ্রিল ২০৮৯, মার্চে ২০৫৪, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৩০ ও জানুয়ারিতে ১৪৪০টি।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সে হামলা-ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এ সময় রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, শটগানসহ ৫ হাজার ৭৫৩ অস্ত্র লুট হয়। যার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৮৪টি। এখনো বেহাত ১ হাজার ৩৬৯ অস্ত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগ্নেয়াস্ত্র বেশি দিন বেহাত থাকলে, তা অপরাধ জগতে চলে যেতে পারে। এতে জনজীবনের নিরাপত্তায় হুমকি বাড়তে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ৬৬টি। ২২টি ঘটনায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে গণপিটুনিতে ৮৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ঢাকাতেই মারা গেছেন ৪৫ জন। এ ছাড়া এই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ৪৪ জন।