ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট, ২০২৫

গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগ ধ্বংসের খলনায়ক খায়রুল হক

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২৫, ০১:২৭ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

স্বৈরাচারের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াত শুরু থেকেই সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করে আসছিল। তার পরেও তাকে গ্রেপ্তারে এত বিলম্ব হওয়ায় অনেকে ক্ষোভ জানান। বেশ কিছু বিতর্কিত রায় ও সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাপক সমালোচিত তিনি।

তার দেওয়া রায় দেশের গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো কার্যকরভাবে ধ্বংস করতে গুরুতর ভূমিকা পালন করে। খুনি হাসিনার দুর্ধর্ষ ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা, বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচনব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে তিনি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি নামের কলঙ্ক খায়রুল হকের অপকর্মের তালিকা ও ভয়াবহতা এতটা দীর্ঘ যে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হলেও তার অপরাধের যথাযথ শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। 

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তার অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন চলছিল। কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন, তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেপ্তার করে। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। 

তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারপতি খায়রুল হক নানা ধরনের দুর্নীতি-অপকর্মে যুক্ত হন। তা ছাড়া তিনি জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যত অবিচারের রায় দিয়েছেন, দেশের মানুষের কাছে বিতর্কিত রায়দাতা বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক পরিচিত। খায়রুল হক একই সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়িছাড়া করার নেপথ্যে কাজ করেন। একাধিক আইনজীবী দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন খায়রুল হক। তার বিচার হওয়া জরুরি।  

ঢাকা বার কাউন্সিলের একাধিক আইনজীবী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিগত দিনে আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং দেশের গণতন্ত্রকে বিপথগামী করে জনগণের বিপক্ষে রায় দিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেন বিচারপতি খায়রুল হক। তা ছাড়া তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেন।  শুধু তাই নয়, বিচার বিভাগের প্রায় অধিকাংশ জায়গায় তিনি রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অন্যায়-অবিচার করেছেন। 

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে খায়রুল হক ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলে ১৩ আগস্ট তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বিচারাঙ্গনে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এই বিচারপতির বেশ কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।

তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েক দিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন।

এতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি হয়। এ কাজে তিনি মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেন। রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি।

এ ছাড়া বিতর্কিত একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৮ আগস্ট ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন এবং জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়।

বিচারপতি খায়রুল হক বিতর্কিত অপকর্মের তল্পিবাহক নায়ক!

জাল-জালিয়াতি করে রায় দেওয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগসহ একাধিক মামলায় অবশেষে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। বিতর্কিত অপকর্মের তল্পিবাহক এই নায়ককে গ্রেপ্তারে এত বিলম্ব হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন নেটিজেনরা। খুনি হাসিনার পতনের পরও তাকে গ্রেপ্তারে এক বছর সময় নেওয়ায় অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করেছেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেন। এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে তিনি সংকটের সূচনা করেছিলেন, যা থেকে ফ্যাসিবাদ শেকড় গাড়ে। বাংলাদেশের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই রায়কে কেন্দ্র করে দেশে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংঘাত ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের আয়নাঘর, গুম, খুন, নির্যাতন-নিপীড়নে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আমলের এই প্রধান বিচারপতি তার ওপর ন্যস্ত বিন্দুমাত্র আমানত রক্ষা করেননি। ইতিপূর্বে কেউ দেশ ও জাতির এত বড় ক্ষতি করেনি। তার হঠকারী রায়ে গুম, খুন, লুণ্ঠনসহ সব অপকর্মের লাইসেন্স পেয়ে যান শেখ হাসিনা। নেটিজেনরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেরিতে হলেও তাকে পাকড়াও করেছে। জাতি এখন তার সুষ্ঠু বিচার এবং ন্যায্য শাস্তি দেখতে চায়। তিনি ইতিহাসের শিক্ষণীয় শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি কিছু জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। অবসর গ্রহণের পরও তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন, যা বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণœ করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ এনে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এ ছাড়া, তার বিরুদ্ধে রায় জালিয়াতি ও সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তনে জালিয়াতির অভিযোগে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় দ-বিধির ২১৯ (বিচারক হিসেবে বিদ্বেষপূর্ণভাবে বা দুর্নীতিমূলকভাবে বেআইনি রায় দেওয়া), ৪৬৬ (জালিয়াতি) এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম জানান, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নামে বিধিবহির্ভূতভাবে প্লট নেওয়া থেকে শুরু করে অবৈধভাবে বিভিন্ন সম্পদের মালিক হয়েছেনÑ এমন নানা ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুদক।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কারণে আয়নাঘর তৈরি হয়েছিল। গণতন্ত্র ধ্বংস করে তিনি হাজারো মানুষ হত্যার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ক্ষমতা অপব্যবহারের কারণে দেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণতন্ত্র ধ্বংস করাসহ তিনি রীতিমতো রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পদে পদে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।  

জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে খায়রুল হকের বিতর্কিত কর্মকা-ের মধ্যে রয়েছেÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম বাতিল, দুই বিতর্কিত বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, চিকিৎসার নামে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া এবং জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউকের প্লট গ্রহণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।