ঢাকা শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

৭২ ঘণ্টায় ৬ দেশে হামলা ইসরায়েলের

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ১১:১৬ পিএম

গাজা সংঘাত নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার ৬ দেশে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত মঙ্গলবার থেকে গত ৭২ ঘণ্টায়  ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, কাতার ও ইয়েমেনে টার্গেটেড হামলা চালানো হয়। এতে শুধু গাজা উপত্যকাতেই অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছেন। ইয়েমেনে নিহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩৫ জন। সব মিলিয়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। কারণ তারা তাদের কৌশলগত অবস্থান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করতে পারে। 

কাতারের দোহায় ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর হামলার কথা উল্লেখ করে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে হামাসের শীর্ষ নেতা হিজবুল্লাহ মহাসচিব শেখ নাঈম কাসেম বলেন, ‘সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে।’ 

কাতারের রাজধানী দোহায় মঙ্গলবার হামলা চালায় ইসরায়েল। গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করার সময় এই হামলা চালানো হয়। হামলায় ছয়জন নিহত হয়। যার মধ্যে রয়েছে- হামাসের সিনিয়র নেতা খলিল আল হায়ার ছেলে, তিনজন দেহরক্ষী এবং কাতারের নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মকর্তা। যদিও হামলা থেকে বেঁচে যান আলোচনার টেবিলে অংশ নেওয়া নেতারা। কাতারে হামলা চালানোর বিষয়টি ছিল ইসরায়েলের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। 

কাতারে হামলার পর বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত বিরোধী এবং শত্রুদের লক্ষ্য করে হামলা শানিত করার হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। 

তিনি বলেন, ‘আমি কাতার এবং অন্যান্য সব দেশকে বলছি যারা সন্ত্রাসী আশ্রয় দেয়, আপনারা তাদের বহিষ্কার করুন অথবা তাদের বিচার করুন- যদি না করেন, আমরা করব’। 

এদিকে দোহায় হামলার জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল রহমান আল থানি। প্রধানমন্ত্রী আল থানি বলেছেন, সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন মেনে নেওয়া হবে না। ফিলিস্তিনে চলমান বর্বরতা বন্ধের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতা অব্যাহত রাখবে কাতার। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলে নেতানিয়াহুকে বিচারের আওতায় আনারও আহ্বান জানিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে কাতারে হামলার ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে ফোনালাপে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রতি ‘তীব্র হতাশা’ প্রকাশ করেছেন এবং হামলার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে বলেছেন, দোহায় হামাসের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করা অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ ছিল। তিনি আরও জানান, এই হামলার খবর তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনী থেকে জানতে পারেন, কিন্তু ইসরায়েল আগে কিছু জানায়নি। এটা এমন এক মিত্র দেশের ভূখ-ে হামলা চালানো হয়েছে, যারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে। 

গাজায় অব্যাহত বোমাবর্ষণ :

গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় গাজায় অন্তত ১৫০ জন নিহত ও ৫৪০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। শুধু সোমবারেই ৬৭ জন নিহত হন এবং ৩২০ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে ১৪ জন নিহত হন ত্রাণ সংগ্রহের সময় এবং আরও ৬ জন অনাহারে মারা যান। যাদের মধ্যে ছিল দুটি শিশুও। গত মঙ্গলবার নিহত হন আরও ৮৩ জন, আহত হন ২২৩ জন। ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটিতে উঁচু ভবন, অবকাঠামো এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস করছে, ফলে বহু মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছেন।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে গাজায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৪ হাজার ৬৫৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪০৪ জন ক্ষুধাজনিত কারণে মারা গেছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের মৃত বলে মনে করা হচ্ছে।

কাতার :

গাজায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছিল কাতারে। এ সময় কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের একটি নেতৃত্বাধীন দপ্তরে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। গত মঙ্গলবারের এই হামলায় ৬ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল-হাইয়ার ছেলে, আল-হাইয়ার দপ্তরের পরিচালক, তিন দেহরক্ষী এবং একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তবে হামাসের শীর্ষ নেতারা অক্ষত রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। 

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, এই অভিযান সীমান্তের বাইরে চালানো ধারাবাহিক হামলার অংশ। গত ৭২ ঘণ্টায় এটি ছিল ষষ্ঠ দেশ যেখানে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে মোট সাতটি দেশে অভিযান চালানো হলো। 

লেবানন :

যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গত সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান পূর্ব লেবাননের বেকা উপত্যকা ও হারমেল জেলায় হামলা চালায়। এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা হেজবুল্লাহর অস্ত্রাগার এবং সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তবে, এই দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। হেজবুল্লাহ এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। গত নভেম্বরে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির এটি সর্বশেষ লঙ্ঘন। এই যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিন লেবাননের ভূখ-ে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে হামলা অব্যাহত রেখেছে। একইসাথে, যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে তারা পাঁচটি সীমান্ত ফাঁড়িতে নিজেদের দখল বজায় রেখেছে।

সিরিয়া :

গত সোমবার গভীর রাতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) জানিয়েছে, এই হামলায় হোমস প্রদেশের একটি সিরীয় বিমানঘাঁটি এবং লাতাকিয়ার কাছে একটি সামরিক ব্যারাকে আঘাত হেনেছে। সিরিয়ার পররাষ্ট্র ও প্রবাসী মন্ত্রণালয় এই হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের ‘প্রকাশ্য লঙ্ঘন’ এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ‘সরাসরি হুমকি’ বলে নিন্দা জানায়। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এই হামলাকে ইসরায়েলের ‘ধারাবাহিক আগ্রাসী কার্যকলাপের’ অংশ হিসেবে উল্লেখ করে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে ইসরায়েল সিরিয়াজুড়ে সামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে শত শত হামলা চালিয়েছে। তারা দখলকৃত গোলান মালভূমিতেও তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে, দামেস্কের সাথে ১৯৭৪ সালের একটি নিরস্ত্রিকরণ চুক্তি লঙ্ঘন করে ডিমিলিটারাইজড বা নিরস্ত্র অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছে।

এসওএইচআর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ৮৬টি বিমান হামলা এবং ১১টি স্থল হামলা রয়েছে। এসব হামলায় প্রায় ১৩৫টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে এবং ৬১ জন নিহত হয়েছেন।

তিউনিসিয়া :

গাজাগামী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র (জিএসএফ) প্রধান জাহাজ ‘ফ্যামিলি বোট’-এ তিউনিসিয়ার সিদি বু সাইদ বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় গত সোমবার গভীর রাতে সন্দেহভাজন ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। পর্তুগালের পতাকাবাহী ২৩ মিটার দীর্ঘ জাহাজটিতে হামলার পর আগুন ধরে যায়। হামলার সময় বহরের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যসহ মোট ছয়জন জাহাজে অবস্থান করছিলেন। জিএসএফ জানিয়েছে, আগুনে জাহাজের মূল ডেক ও গুদামজাত করার স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাত্রীরা দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলেন। জাহাজে থাকা সব কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টরা নিরাপদে আছেন বলে জানানো হয়েছে। ৫০টিরও বেশি জাহাজের জোটের অংশ এই ‘ফ্যামিলি বোট’। গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্যে গঠিত এই জোটে কমপক্ষে ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এটি ২৫ সালের ৩১ আগস্ট যাত্রা শুরু করে এবং পরে সিদি বু সাইদ বন্দরে অন্যান্য জাহাজের সাথে যোগ দেয়।

এরপর মঙ্গলবার গভীর রাতে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা চালানো হয়। তিউনিসিয়ার জলসীমায় যুক্তরাজ্যের পতাকাবাহী ‘আলমা’ নামের আরেকটি ফ্লোটিলা জাহাজেও সন্দেহভাজন ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালানো হয়। এই হামলায় জাহাজের উপরের ডেক আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

ইয়েমেন :

গত বুধবার ইয়েমেনের রাজধানী সানায় হুথি অবস্থানগুলোকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় সানা বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা এক মাসের মধ্যে ওই স্থানে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা। এর আগে গত ৬ মে ইসরায়েল এই বিমানবন্দরে আঘাত হেনে টার্মিনাল ভবন ধ্বংস করে এবং রানওয়ের মারাত্মক ক্ষতি করে।

ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন আরও ১৩১ জন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আলজেরিয়ার এক প্রতিবেদনে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সানার আল-তাহরির এলাকার আবাসিক ভবন, একটি চিকিৎসা কেন্দ্র এবং আল-জাওফ প্রদেশের রাজধানী আল-হাজমের সরকারি কমপাউন্ডে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। 

২৫ সালের ২৮ আগস্ট ইসরায়েলি বিমান হামলায় সানায় হুথি সরকারের একটি বৈঠক লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। সেই হামলায় হুথি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ আল-রাহাওয়ি এবং আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন।