অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কার্কির শপথ গ্রহণের পর আগামী ৫ মার্চ নেপালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে জারি করা কারফিউ ও অন্যান্য বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে নেপাল সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তে নেপালের জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
এদিকে গতকাল শনিবার এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উপ-প্রেসসচিব বলেন, অভিনন্দন বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা নেপালের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে সুশীলা কার্কির দায়িত্ব নেওয়ার প্রশংসা করেন। প্রধান উপদেষ্টা আশা করেন, নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নেপাল শান্তি, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথে অগ্রসর হবে।
প্রধান উপদেষ্টা তার বার্তায় দুই দেশের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদারের প্রত্যাশা জানান। পাশাপাশি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রাণহানির ঘটনায় নেপালের জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। চিঠির শেষে নেপালের জনগণের শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য ও সফলতা কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হলেন ৭৩ বছর বয়সি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। গত শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পাউডেলের উপস্থিতিতে শীতল নিবাসে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়ানো হয়। শপথ অনুষ্ঠানে নেপালের ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধান বিচারপতি, সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা ও বিদেশি কূটনীতিকেরা অংশ নেন।
কার্কির শপথের পর রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কার্কির সুপারিশে তিনি (রাষ্ট্রপতি) সংসদ ভেঙে দিয়েছেন এবং আগামী বছরের ৫ মার্চ নতুন নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। নেপালের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের প্রেস উপদেষ্টা কিরন পোখারেল এএফপিকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের ৫ মার্চ নেপালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’। নতুন সরকার গঠনের পর সুশীলা কার্কির প্রধান দায়িত্ব হলোÑ আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন সংসদীয় নির্বাচন পরিচালনা করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা।
নতুন প্রধানমন্ত্রী এর আগে দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতিও ছিলেন। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় এক বছর তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণু’ অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন সুশীলা। ওই অবস্থানের কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করেন বিক্ষোভকারী তরুণেরা। কয়েক দিনের মধ্যে নতুন সরকারের মন্ত্রীদের নাম জানাবেন কার্কি।
এদিকে নতুন প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে নেপালের সাধারণ মানুষ। সমাজকর্মী সুরজ ভট্টরাই (৫১) বলেন, ‘নেপাল তার প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখবেন এবং সুশাসনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন’। কাঠমান্ডুর একটি দোকানে কর্মরত ২৩ বছর বয়সি দুর্গা মাগার বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত আপাতত ভালো। এই সময়ে জনগণের, বিশেষ করে তরুণদের কাছে প্রধান সমস্যা হলো দুর্নীতি। এটি বন্ধ করা দরকার’। দুর্গা মাগার আরও বলেন, ‘আমরা জানি না ভবিষ্যতে কী হবে, তবে আমরা সন্তুষ্ট। আশা করি, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি এতটা উত্তেজনাপূর্ণ থাকবে না’।
তরুণ প্রজন্ম বা জেন-জিদের নেতৃত্বে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলমান তীব্র বিক্ষোভ ও সহিংসতার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে নেপাল। এর আগে নেপালি সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশব্যাপী কঠোর কারফিউ জারি করেছিল। গতকাল শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকার কথা ছিল। তবে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় গতকাল ভোর থেকেই কাঠমান্ডুসহ সারা দেশে গণপরিবহন পুনরায় চালু হয়েছে। দীর্ঘ সময় পর দূরপাল্লার বাসগুলো কাঠমান্ডু থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এর আগে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই গোঙ্গাবু বাস টার্মিনাল থেকে কিছু বাস চলাচল শুরু করেছিল। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের পরিবেশও শান্ত হয়ে এসেছে। দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। রাস্তায় সৈন্যদের উপস্থিতি কমিয়ে আনা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ও সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত সোমবার শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নেপালের কে পি শর্মা অলি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ বিধ্বংসী রূপ নেয়। নেপালে ২০০৮ সালে এক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ও রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ এ বিক্ষোভে কমপক্ষে ৫১ জন নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। পুলিশ বলছে, নিহতদের মধ্যে নেপালের তিন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া ২১ বিক্ষোভকারী, অন্যান্য ১৮ জন ও ৯ বন্দি আছেন। বিক্ষোভের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ও তার মন্ত্রীরা পালাতে ও আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। এ সময় অনেকেই হতাহত হন। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। রাজনৈতিক অচলাবস্থা তীব্র হয়ে ওঠে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি ঐকমত্যে ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে দেশটির রাষ্ট্রপতি, আন্দোলনে থাকা জেন-জি ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টা ছিল। সেই ধারাবাহিকতাতেই সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে দেশটির নতন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী এখন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ করছে এবং দেশজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। এই পদক্ষেপের ফলে নেপালের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।