চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত নতুন মাসুল গতকাল সোমবার থেকে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের গড়ে ৪১ শতাংশ ব্যয় বাড়ল। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনের মাসুল। বন্দরের সেবা নেওয়ার জন্য এখন থেকে কনটেইনারপ্রতি (২০ ফুট লম্বা) বাড়তি মাসুল দিতে হবে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। এসব বাড়তি খরচ ভোক্তাদের থেকেই আদায় করবেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ভোক্তার কাঁধে পড়বে বাড়তি খরচের বোঝা। এতে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত নতুন মাসুলের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। গত রোববার দিবাগত রাতে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
অর্থনীতির কঠিন সময়ে বন্দর ও আইসিডির একসঙ্গে চার্জ বাড়ানোর এমন ঘোষণা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মার্কিন শুল্কহার নিয়ে এমনিতেই বিপদে আছে রপ্তানিকারকরা। এর মধ্যে বর্ধিত শুল্ক কার্যকর হওয়ায় রপ্তানি পণ্য পরিবহনের খরচ অনেক বেড়ে গেল। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে আমদানি পণ্যের দামও বাড়বে, যা ভোক্তাকে আরও চাপে ফেলবে। কারণ, পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়লে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, নতুন প্রস্তাবে বন্দরে প্রবেশ ফি, পাইলটেজ চার্জ, লোডিং-আনলোডিং চার্জসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফি অর্ধেক থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
গত ২৪ জুলাই বন্দরের প্রস্তাবিত মাসুল অনুমোদন করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। সে সময় একসঙ্গে গড়ে ৪১ শতাংশ হারে মাসুল বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি জানান বন্দর ব্যবহারকারীরা। এরপর বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে এক দফা আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু ব্যবহারকারীদের আপত্তি আমলে না নিয়েই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ফলে মাসুল বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত বন্দর নিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেটিই বহাল থাকল।
সরকারের ভাষ্য, ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম বন্দরের মাসুল বাড়ানো হয়েছে। মাসুল বাড়ানোর পরও তা আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম।
মাসুল বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবহারকারীদের বড় আপত্তি ছিল একলাফে গড়ে ৪১ শতাংশ মাসুল বাড়ানো হলে তাতে হঠাৎ করে ভোক্তার ওপর চাপ বেড়ে যাবে। রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। আবার ভবিষ্যতে বন্দরের দুটি টার্মিনাল ছাড়া সব কটিই যাচ্ছে বিদেশিদের হাতে। ফলে মাসুল বাড়ানো হলে তার বড় সুফল পাবে বিদেশি অপারেটররা।
ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দর ১৯৮৬ সালের পর শুল্ক বাড়ায়নি দাবি করলেও তা সঠিক নয়। আমরা বন্দরকে চার্জ পরিশোধ করি ডলারে। ১৯৮৬ সালে ডলারের রেট কত ছিল। আর এখন কত, এটি বিবেচনায় আনলেও বোঝা যায় আমাদের খরচ কত বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্ধিত মাসুলের কারণে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে তৈরি পোশাক খাত। কারণ, রপ্তানি খাতের কাঁচামাল কনটেইনারে আমদানির সময় একবার বাড়তি মাসুল দিতে হবে। আবার রপ্তানির সময় আরেক দফা মাসুল দিতে হবে। সেই হিসাবে কাঁচামাল ও প্রস্তুত পণ্যে দুই দফায় বাড়তি মাসুল দিতে হবে, যা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়।
কোথায় কত বাড়ল
নতুন মাসুল হার তুলনা করে দেখা যায়, বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কনটেইনার (২০ ফুট লম্বা) থেকে গড়ে মাসুল আদায় করে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। নতুন মাসুল কার্যকর হওয়ায় এখন কনটেইনারপ্রতি বাড়তি দিতে হবে গড়ে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। তাতে সব মিলিয়ে কনটেইনারপ্রতি গড়ে মাসুল দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কনটেইনারে মাসুল বাড়ছে গড়ে ৩৭ শতাংশ।
বন্দরের গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব ধরে নতুন মাসুলের ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি বিনিময়মূল্য ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়লে মাসুলও বাড়বে। কারণ, বন্দর কর্তৃপক্ষ ডলার হিসাবে মাসুল আদায় করে।
কনটেইনার ছাড়াও কনটেইনার জাহাজের সেবা নেওয়ার জন্য আলাদা মাসুল দিতে হয়। আবার কনটেইনারভেদে খরচ কমবেশি হবে। যেমনÑ আমদানি কনটেইনার হলে মাসুল বাড়বে ৫ হাজার ৭২০ টাকা। রপ্তানি কনটেইনার হলে মাসুল বাড়বে ৩ হাজার ৪৫ টাকা।
কনটেইনারে মাসুল বাড়ার বড় খাত হলো জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো ও নামানো। প্রতি একক কনটেইনার ওঠানো বা নামানোর জন্য আগে মাসুল ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার। এখন তা বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে। অর্থাৎ এই একটি মাসুল বেড়েছে ২৪ দশমিক ৬০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার টাকা।
কনটেইনার পণ্যে প্রতি কেজিতে আগে গড়ে মাসুল দিতে হতো ১ টাকা ২৮ পয়সা। সোমবার থেকে নতুন মাসুল কার্যকর হওয়ায় এখন প্রতি কেজি কনটেইনার পণ্যে বাড়তি দিতে হবে ৪৭ পয়সা।
সমুদ্রপথে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় পুরোটাই হয় কনটেইনারে। আবার কনটেইনারে করে শিল্পের কাঁচামাল ও মূল্যবান যন্ত্রপাতিও আমদানি হয়। সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের ৯৯ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন হয়। ফলে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে মাসুল বাড়ানোর প্রভাব বেশি পড়বে বলে জানান ব্যবহারকারীরা।
বন্দর দিয়ে কনটেইনার ছাড়াও সাধারণ পণ্য পরিবহন হয়। বন্দরের হিসাবে, প্রস্তাবিত বর্ধিত মাসুল কার্যকর হলে সব ধরনের পণ্যে কেজিপ্রতি মাসুল বাড়বে গড়ে ১৪ পয়সা। বর্তমানে কেজিপ্রতি ৩৫ পয়সা মাসুল দিতে হয়। সেই হিসাবে গড়ে মাসুল বাড়ছে ৪১ শতাংশ।
কনটেইনারের মতো সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজগুলো বন্দর সুবিধার খুব সামান্যই ব্যবহার করে। যেমনÑ বাল্ক জাহাজের বেশির ভাগই সাগরে নোঙর করে ছোট জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে মোট পণ্যের ৫৯ শতাংশই খালাস হয়েছে বহির্নোঙরে।
রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে যেসব চার্জ বাড়ানো হলো, তার মধ্যে ২০ ফুট কনটেইনারের প্যাকেজ চার্জ তিন হাজার ৭১৩ থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ৯০০ টাকা করা হয়েছে। ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে চার হাজার ৯৫০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ হাজার ২০০ টাকা। আগে ৪০ ফুট হাই-কিউব ও ৪৫ ফুট কনটেইনারে ভিন্ন কোনো চার্জ ছিল না। এ ক্ষেত্রে আদায় করা হতো ৪০ ফুট কনটেইনারের সমপরিমাণ প্যাকেজ চার্জ। তবে এবার সেটি ছয় হাজার ৬৫০ থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা।
গ্রাউন্ড রেন্ট চার্জ প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা, ৪০ ফুট ও ৪০ হাই-কিউব এবং ৪৫ ফুটের কনটেইনারের জন্য ৭০ টাকা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পণ্য সিএফএস শেডে স্টোর করে রাখার ক্ষেত্রে সাত দিন ফ্রি টাইমের পর প্রতি ঘনমিটার পণ্যের জন্য ১৬ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা এবং শাটআউট কার্গোর ক্ষেত্রে ফ্রি টাইম ছাড়াই প্রতি ঘনমিটার পণ্যের জন্য ১৬ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্টোরিং চার্জ তিন টাকা বাড়িয়ে ছয় টাকা এবং রেফার কনটেইনারের প্লাগইন চার্জ ৫০০ বাড়িয়ে দুই হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রায় ১৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজের বন্দরে প্রবেশ ফি বর্তমানে চার হাজার ৩৬২ ডলার। এটি বাড়িয়ে ছয় হাজার ৮৩৪ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে পাইলটেজ চার্জের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৬ শতাংশ এবং লোডিং-আনলোডিং চার্জের ক্ষেত্রে ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
২০২২ সালে স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আইডম কনসাল্টিং, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেকচার এবং বাংলাদেশের লজিকফোরাম লিমিটেডকে ট্যারিফ কাঠামো পর্যালোচনা ও নতুন প্রস্তাবনা তৈরির জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের পরামর্শ মেনেই নতুন চার্জ নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, শিপিং এজেন্ট থেকে ১০ শতাংশের কম-বেশি বাড়ানোর দাবি ছিল। এ নিয়ে আরেকটা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে মাসুল বাড়ানোর বিষয়টি দুঃখজনক। কারণ, মাসুল বাড়লে তা দিন শেষে ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় হবে। ভোক্তার কাঁধে পড়বে বাড়তি খরচের বোঝা।
বছরে কত মুনাফা
বন্দর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর আয় করেছে পাঁচ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে তাদের খরচ হয়েছে দুই হাজার ৩১৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এই হিসাবে সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের মুনাফা হয়েছে দুই হাজার ৯১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। অভিন্ন চিত্র ছিল এর আগের অর্থবছরেও। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের উদ্বৃত্ত ছিল দুই হাজার ৭১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিট মুনাফার প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।