গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া সামরিক বাহিনীর ১৫ জনকে হেফাজতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনা সদর। তবে একজন এখনো লাপাত্তা। মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ কর্মস্থলে অবৈধভাবে অনুপস্থিত। গুমের মামলায় ট্রাইব্যুনাল থেকে পরোয়ানা জারির পর সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার না করায় জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের ক্ষোভের মধ্যে গতকাল শনিবার ঢাকা সেনানিবাসের মেস আলফাতে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান এ তথ্য জানান।
সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে মোট ২৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হলেও চাকরিরত ১৫ জনকে হেফাজতে রাখা হয়েছে। লাপাত্তা একজনের বাইরে আটজন সামরিক বাহিনী থেকে এরই মধ্যে অবসর নিয়েছেন। একজন রয়েছেন অবসরের প্রক্রিয়ায়।
আওয়ামী লীগ আমলের গুমের ঘটনায় দুটিসহ মোট তিনটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল গত বুধবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩২ জনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেন। তাদের মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। পরোয়ানা জারির দিনই তা সংশ্লিষ্ট ১২টি দপ্তরে পাঠানোর কথা জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর কর্মকর্তারা।
গতকাল বিকেলের সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান সেই পরোয়ানা এখনো হাতে না পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, তবে এরই মধ্যে তারা পদক্ষেপ নিয়েছেন। মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, তিনটি মামলায় ২৫ জন সেনা সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অবসরে আছেন ৯ জন, এলপিআরে একজন আর সেনাবাহিনীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৫ জন। ৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এলপিআর ও সার্ভিসে থাকা ১৬ জনকে সেনা সদরে সংযুক্ত হতে বলা হয়। ৯ অক্টোবরের মধ্যে সেনা সদরে আসার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ছাড়া বাকি ১৫ জন এসেছেন। তারা পরিবার থেকেও আলাদা থাকছেন।
কবীর আহাম্মদের বিষয়ে মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান বলেন, ‘তিনি ৯ অক্টোবর সকালে বাসা থেকে বের হয়েছেন।
এর পর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবিকে বলা হয়েছে যেন তিনি দেশত্যাগ করতে না পারেন।’ মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ সর্বশেষ সিলেটে সেনাবাহিনীর স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসে (এসআইএন্ডটি) কমান্ড্যান্ট পদে ছিলেন। তিনি ডিজিএফআইয়ে সাবেক পরিচালক। সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তাদের বিচার প্রচলিত আদালতে হবে, নাকি সামরিক আদালতে হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা উঠেছে। তাদের গ্রেপ্তারের দাবিও উঠেছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হেফাজতে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। এর মধ্যে দুটি মামলা হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। অন্যটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়।
তিন মামলায় মোট ৩২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তাদের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ পাঁচজন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা রয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক তিন মহাপরিচালক (ডিজি) রয়েছেন, এদের একজন বেনজীর আহমেদ পুলিশের মহাপরিদর্শকও (আইজি) হয়েছিলেন। পুলিশের বাকি দুজন ছিলেন ওসি।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক পাঁচ ডিজি আসামির এই তালিকায় রয়েছেন। তারা সবাই এখন অবসরে। বিভিন্ন সময়ে ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন এমন আরও ছয়জন আছেন তালিকায়। যাদের দুজন অবসরে গেছেন।
বিভিন্ন সময়ে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-অপস) ও পরিচালক (গোয়েন্দা শাখা) ছিলেন এমন ১১ জন সেনা কর্মকর্তাও ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি। এ ছাড়া আসামির তালিকায় নাম রয়েছে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম।
রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চার আসামির মধ্যে দুজন বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম ও মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম মুন। বাকি দুজন পুলিশের কর্মকর্তা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করে ২২ অক্টোবরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য আদেশ দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারের দাবি
গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হিসেবে যেসব সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্ম, যা এখন সংগঠনে রূপ নিয়েছে। আর গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের একাংশের উদ্যোগে গঠিত ছাত্রসংগঠন।
সেনা সদস্যদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে আলাদা বিবৃতি দেয় তারা। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের বিবৃতি আসে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব জাহিদ আহসানের স্বাক্ষরে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ পাঠান আরেকটি বিবৃতি। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘গভীর উদ্বেগ ও তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার কার্যকর করা হয়নি। এই বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচারের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করছে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আমরা মনে করি, গণ-অভ্যুত্থানের পরে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার জাতি করেছে, এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি সেটিকে বিপন্ন করছে।’
‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা ও সৈনিকদের ভূমিকার প্রশংসা করে বিবৃতিতে বলা হয়, কিন্তু বিগত স্বৈরাচারী আমলে কিছু বিচ্যুত কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন।
র্যাব, ডিজিএফআই এবং গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রচ্ছায়ায় গুম, খুন ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যা কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অপরাধীদের বিচার না হলে সেনাবাহিনীর মর্যাদা কলঙ্কমুক্ত হবে না। অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারপ্রক্রিয়া দৃশ্যমান করা এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।