ঢাকা রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে  রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-লুটপাট 

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৫, ১১:১৫ পিএম

*** অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে : ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

*** অনিয়মের বিষয়টি নলেজে আছে। এ ঘটনায় প্রকল্প পরিচালকসহ অনেককে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে : মো. ছাইফুল আলম, মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর 

নেত্রকোনা সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় বিতরণ করা হয়েছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন। মেশিনগুলো ৭০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও কৃষকদের ভাগ্যে তা জোটেনি। স্থানীয় এক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেওয়া হয়েছে ১০টি মেশিন। মো. সুলতান নামের ওই কৃষি কর্মকর্তার বাড়িতে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে পাঁচটি মেশিন পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু নেত্রকোনাই নয়, সুনামগঞ্জেও অভিযান চালিয়ে একই ব্যক্তির একাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন পেয়েছে দুদক। আবার একই মোবাইল নাম্বার দিয়ে একাধিক ব্যক্তি হারভেস্টার মেশিন নিয়েছেন বলে দুদকের অভিযানে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া এক ব্যক্তির নামে বরাদ্দকৃত হারভেস্টার মেশিন উপজেলা কৃষি অফিসারের যোগসাজশে অন্য ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়েছেÑ এরূপ তথ্যও পেয়েছে দুদক টিম। তবে তদন্তের স্বার্থে জড়িতদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সুলতান নয়, সারা দেশে এই কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। যাদের যন্ত্রপাতি পাওয়ার কথা তাদের বদলে পেয়েছেন এলাকার প্রভাবশালী, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মী ও কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন। শুধু বিতরণই নয়, যন্ত্রপাতি কেনাকাটাসহ প্রকল্প পরিচালনায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল অনিয়ম ও দুর্নীতি। কৃষি কর্মকর্তার পাশাপাশি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারীও জড়িত ছিল অনিয়মের সঙ্গে। সম্প্রতি প্রকল্পটির ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কার্যক্রম তদন্ত করে এক হাজার ৭১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার অনিয়ম পেয়েছে কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তর। 

জানা গেছে, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক করতে ২০২০ সালে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই প্রকল্পে উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। কৃষিযন্ত্র কেনার জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের ৭০ শতাংশ এবং অন্য সব এলাকার কৃষকদের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। 

সূত্র জানায়, প্রকল্পের কেনাকাটা থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি বিতরণ সব জায়গায় অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। ভর্তুকিমূল্যে কৃষকদের কৃষিপণ্য দেওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক পেয়েছেন সেই সুবিধা। ভর্তুকিতে থাবা বসিয়েছেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় প্রভাবশালী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির আত্মীয়-স্বজনরা। এদের অনেকে কৃষকদের নামে যন্ত্রপাতি কিনে বিক্রি করে দিয়েছেন উচ্চমূল্যে। কেউ কেউ একটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিয়েছেন একাধিক যন্ত্রপাতি। আবার একই পরিবারের একাধিকজন পেয়েছেন এসব পণ্য। কৃষিকাজের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই এমন অনেকেই ভর্তুকিমূল্যে এসব যন্ত্রপাতি নিয়েছেন। ফলে সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পটি শুরু করেছিল সেই উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে অনিয়মে। 

এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা চাউর হওয়ার পর সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাঠপর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তার প্রমাণও পেয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত প্রকল্পটির সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) তারিক মাহমুদুল ইসলামসহ আরও কয়েক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। 

বড় অনিয়ম যেসব খাতে : এদিকে প্রকল্পটির ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কার্যক্রম তদন্ত করে ২৬ খাতে এক হাজার ৭১২ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছে কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তর। সম্প্রতি এই প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। 

সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন না করে কম্বাইন্ড হারভেস্টারের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ভর্তুকির হারে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার জায়গায় প্রায় ২১ লাখ ৬৩ হাজার এবং ৫০ শতাংশ ভর্তুকির হারে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার জায়গায় প্রায় ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ব্যয়ে যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এতে সরকারের ৯ কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী ৫টি প্রতিষ্ঠান থেকে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট লঙ্ঘন করে কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৩১৯ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকা। কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন আমদানির তুলনায় বিতরণ বেশি দেখিয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি পরিশোধ করায় ৭৮৭ কোটি ৭১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, একই কৃষি যন্ত্র বিভিন্ন অর্থবছরে একাধিকবার বিতরণ দেখিয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি পরিশোধ করায় ২৯৫ কোটি ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার দুর্নীতি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, কৃষকদের মধ্যে বীজ বিতরণের প্রমাণ না পাওয়া সত্ত্বেও বীজ সহায়তা বাবদ অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করায় ১ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, অনুমোদিত কৃষককে কৃষি যন্ত্র সরবরাহ না করে ভিন্ন ব্যক্তিকে সরবরাহ করা সত্ত্বেও সরবরাহকারীকে ভর্তুকি পরিশোধ করায় ২ কোটি ৬ লাখ, চুক্তিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে ভর্তুকির আওতায় ক্রয়কৃত কম্বাইন্ড হারভেস্টার অন্যত্র হস্তান্তর করায় ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা, বিতরণকৃত কম্বাইন্ড হারভেস্টারের সঙ্গে ডেলিভারি চালানে উল্লেখিত ইঞ্জিন নম্বর ও চেসিস নম্বর মিল না থাকা সত্ত্বেও ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করায় ১৩ কোটি ৬৫ লাখ, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার প্রত্যয়নকৃত যন্ত্র সরবরাহ না করে ভিন্ন মডেলের যন্ত্র সরবরাহ করায় ২২ লাখ ৯০ হাজার, একই এনআইডি’র বিপরীতে একাধিক কৃষি যন্ত্র (কম্বাইন হারভেস্টার) সরবরাহ দেখিয়ে সরবরাহকারীকে ভর্তুকি প্রদান করায় ৩৬ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, একই চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বরে একাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার ভিন্ন ভিন্ন কৃষকের মাঝে বিতরণ দেখিয়ে সরবরাহকারীকে ভর্তুকি প্রদান করায় সরকারের ৬৭ কোটি ৩৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা, চেসিস নম্বর, ইঞ্জিন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সত্যতা যাচাই না করে ৪৫৮টি কম্বাইন হারভেস্টার ভিন্ন ভিন্ন কৃষকের নামে সরবরাহ দেখিয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৭০ কোটি ২০ লাখ ৯১ হাজার টাকা লুটপাট করা হয়েছে। 

কৃষি অডিট অধিদপ্তর, দুদক ছাড়াও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি) একই ধরনের যন্ত্র বিভিন্ন দামে (অতিরিক্ত) ক্রয়, যোগ্য ঠিকাদারকে বাদ দেওয়া, প্রকৃত কৃষক নির্বাচন না করাসহ ১০ অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। আইএমইডি বলছে, ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) নির্দেশনা না মানা, কারিগরি কমিটির নির্দেশনা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাবপত্র মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা। এ ছাড়া আরও আছেÑ বাজারদর যাচাই না করে উচ্চ দরে যন্ত্র কেনা, নি¤œ শক্তির যন্ত্র সরবরাহ করা হলেও জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ, কৃষকদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং বাৎসরিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া উচিত হবে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অনিয়মের বিষয়টি আমাদের নলেজে আছে। এই ঘটনায় প্রকল্প পরিচালকসহ অনেককে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।