ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক

ভিন্নমতের মধ্যেই কাল জুলাই সনদ স্বাক্ষর

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৫, ১২:০৬ এএম

নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে আগামীকাল শুক্রবার ১৭ অক্টোবর উৎসবমুখর পরিবেশে স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড মুহাম্মদ ইউনূসও শুক্রবার সনদ স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সনদ নিয়ে জটিলতা কাটাতে গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সব দল নিজের আগের অবস্থান বজায় রেখেই সনদে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়। জুলাই জাতীয় সনদের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করে বিএনপি জুলাই সনদে সই করবে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এক দিন বাকি আছে। ওই দিনই দেখা যাবে সই করব কি না।

তবে সই নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখি না। আর এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, সেটা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। গণভোটের বিষয়ে যে প্রশ্ন, দিনক্ষণ, সেগুলো আমাদের কাছে, জাতির কাছে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তবে বাম গণতান্ত্রিক জোট জানিয়েছে, তারা জুলাই জাতীয় সনদে সই করবে না। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হতে গেলেও এখনো কিছুটা হলেও ভিন্নমত বা অনিশ্চয়তা রয়ে গেল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টার পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

শুক্রবার জুলাই সনদে স্বাক্ষর, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনÑ প্রধান উপদেষ্টা: আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন হবেই বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবেই। এই যে ঐকমত্য কমিশনের যে সনদ, এটা সনদেরই অংশ এখন। এটার সঙ্গে এটা জড়িত। এই যে ঘোষণা আমরা করলাম, এটা আমাদের রক্ষা করতে হবে। এটা এমন না, কথার কথা বলে ফেলেছি, ওই রকম না। এটা ফেব্রুয়ারিতে হবে এবং ওই যে বারবার বলেছি, এটা উৎসবমুখর নির্বাচন হবে।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘অতি জরুরি’ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনারা যেমন সবাই মিলে সনদ তৈরি করেছেন, আমাদের সরকারের দায়িত্ব হলো সবাই মিলে উৎসবমুখর নির্বাচনটা করে দেওয়া। তাহলেই আমাদের কাজ পরিণত হলো।’

রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনকে একান্তভাবে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য তিনি বৈঠকে যোগ দিয়েছেন বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি জানান, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে, কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোচনা করা এবং সন্তোষজনকভাবে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশন মিলে এর সমাপ্তি আনায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাদের ধন্যবাদ জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন, এটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর পলিটিক্যাল সিস্টেমের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।’

জুলাই সনদ রচনাকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, এই অভ্যুত্থানের এটাই আমার মনে হয় পরবর্তী অধ্যায় সঠিকভাবে রচিত হলো। যে সংস্কারের কথা আমরা মুখে বলে যাচ্ছিলাম, আপনারা সেই সংস্কার, প্রকৃতপক্ষে যে সংস্কার হবে, তা করে দেখিয়েছেন। কাজেই আমরা এই জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে পুরো জাতি বড় রকমের উৎসবের মধ্যে আমরা শরিক হবে।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে কলম দিয়ে স্বাক্ষর করা হবে, সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। মানুষ তাদের ভুলতে পারবে না। এটা এমন একটা ঘটনা যে ঘটনার ভেতরে থেকে এর বিশালত্ব বোঝা যাচ্ছে না। মাসের পর মাস বৈঠক করে হতাশা এসেছে, মনে হয়েছে, এটা হয়তো অসমাপ্ত থেকে যাবে। তবে এটা অসমাপ্ত থেকে যায়নি। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ জাতির জন্য একটা মস্ত বড় সম্পদ হয়ে রইলো।’

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘যেসব দলিল তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো হারিয়ে যাবে না। এগুলো জনসাধারণের মধ্যে সহজ ভাষায় প্রচার করা হবে। যাতে সবার মনের মধ্যে থাকে, কেন একমত হয়েছি।’ সরকার হিসেবে জুলাই সনদ ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, যেসব বিতর্ক হয়েছে, সেগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভিডিও করে ও বই করে রাখা হবে, যেন এগুলো সম্পদ হিসেবে থাকে, হারিয়ে না যায়। যাতে সবাই জানতে পারে, কেমন জাতি গড়ার জন্য এগুলো করা হয়েছে।

সনদ ও নির্বাচন বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উত্তরণটা কীভাবে হবে, এটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সেটার উত্তরও জুলাই সনদে দেওয়া আছে। এ উত্তর নিয়ে যেন সন্তোষভাবে উত্তরণটা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেভাবে রূপান্তরটি হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিপূর্ণ প্রচেষ্টা হবে, আপনারা যত কষ্ট করে এগুলো রচনা করছেন, সেটা যেন আমরা বাস্তবে রূপান্তর করতে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে এবং আমাদের দৈনন্দিন রাজনৈতিক মাধ্যমে যেন আমরা সেটাকে রূপান্তর করতে পারি। এ হলো আমাদের আশা। আগামী শুক্রবারে আমরা সেই আশাকে সারা জাতির সামনে নিয়ে আসব।’

১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা উৎসবমুখরভাবে সেখানে যাব এবং এই দলিলে সই করব এবং উৎসব করব। সবাই, সারা জাতি এটায় শরিক হবে। আপনারা তাদের সামনের সারির মানুষ, যারা প্রকৃত সই করছেন। সারা দেশের মানুষ চিন্তার মধ্যে, তাদের ভাবনার মধ্যে আপনাদের সঙ্গে সই করছে। জাতির জন্য এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করে জুলাই সনদে সই করবে বিএনপি: জুলাই জাতীয় সনদের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করে বিএনপি জুলাই সনদে সই করবে। প্রধান উপদেষ্টার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, জুলাই সনদ সইয়ের পর বাস্তবায়নের জন্য কমিশন সরকারকে সুপারিশ করবে। জাতীয় নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আপনার সঙ্গে প্রতিরক্ষার বাহিনীর সম্পর্কের অবনতি না হোক, রাষ্ট্রের ব্যালান্স রাখতে হবে। আমরা নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে চাই না, আমরা এটা মোকাবিলা করতে পারব না।’

সই নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখি না-জামায়াত: জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এক দিন বাকি আছে। ওই দিনই দেখা যাবে সই করব কি না। তবে সই নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখি না। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগীয় সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, গণভোট জাতির ম্যান্ডেট পাওয়ার একমাত্র উপায়, এবং সেই ম্যান্ডেট অর্জনের প্রক্রিয়ায় কোনো বিলম্বের সুযোগ নেই। তাই নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের আয়োজন করতে হবে, যাতে জুলাই সনদটি আইনগত ভিত্তি পায়। তিনি বলেন, এ কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘণ্টার পর ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিন এখানে আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনার পর অনেক বিষয়ে একমত হয়েছেন, আবার অনেক বিষয়ে মতভেদ (ফরভভবৎবহপব ড়ভ ড়ঢ়রহরড়হ) রয়ে গেছে। আমি মনে করি, মতের পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রেই ঐক্যকে সুদৃঢ় করে-কারণ ঐক্য শুধু এক মতের ভিত্তিতে নয়, বরং ভিন্ন মতও ঐক্যকে দৃঢ় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেসব ভিন্ন মতকেও আমরা শ্রদ্ধা জানাই।’

সনদ স্বাক্ষরের আগে বাস্তবায়নের ‘পথ পরিষ্কার’ করার দাবি এনসিপির: জাতির কাছে ‘সবকিছু স্পষ্ট করে’ জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিকে অগ্রসর হলে এর বাস্তবায়ন এবং ‘জাতির প্রত্যাশা পূরণ’ সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির-এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। গতকাল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জরুরি বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। এনসিপি সদস্য সচিব বলেন, ‘আমরা চাই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথটাকে পরিষ্কার করে তারপরে আমরা সনদ স্বাক্ষর করার দিকে অগ্রসর হব।’

সরকার শুক্রবার জুলাই সনদ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিলেও এর বাস্তবায়নের পথ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়ে গেছে। সেই মতপার্থক্য মিটিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটাতে রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের নিয়ে এই জরুরি বৈঠকে বসেন ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এনসিপির অবস্থান তুলে ধরে আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা অনেক রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে আজকের এই দিনে সবাই এখানে উপনীত হতে পেরেছি। দেশে যাতে কখনো ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে এবং গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হতে সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ প্রণয়নের দিকে অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তের কিছু বিষয় আমাদের মধ্যে শঙ্কার জায়গা তৈরি করেছে। আসলে জাতিকে অস্পষ্ট রেখে কোনো উদ্যোগকে সফল করা সম্ভব নয়। সনদের যে খসড়া পেয়েছি, সেখানে নোট অব ডিসেন্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হয়নি, সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন।’ কীভাবে সেগুলোকে বাস্তবায়ন করা হবে সে ‘পথরেখা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, তার আশা শেষ মূহূর্তে সব দল জুলাই সনদে সই করবে। গণঅধিকার পরিষদ জুলাই জাতীয় সনদে সই করবে জানিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, দু-একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে পরিবেশ ঘোলা করার চেষ্টা করছে। গণতন্ত্র মঞ্চ’জোটভুক্ত সব দল জুলাই জাতীয় সনদে সই করবে বলে জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তবে বাম গণতান্ত্রিক জোট জানিয়েছে, তারা জুলাই জাতীয় সনদে সই করবে না।

ইসলামী আন্দোলনের নেতা আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, সনদে কোনো নোট অব ডিসেন্ট থাকতে পারবে না। নভেম্বরের মধ্যে গণভোট হতে হবে। সনদে স্বাক্ষর করব কি না, আগামীকালের মধ্যে জানাব। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র সংবিধানের তপশিল থেকে বাদ দিলে গণফোরাম সই করবে না।

বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি (রব), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।