চলতি বছর বিগত দুই দশকের তুলনায় এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হয়েছে। এবার প্রভাব পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে কিছুটা ভর্তিযুদ্ধ হলেও অধিকাংশ বেসরকারি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো পাবে না শিক্ষার্থী। ইউজিসির তথ্যমতে, এবার এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের স্নাতক-সমমান পর্যায়ে ১০ লাখ ৮০ হাজারের বেশি আসন শূন্য থাকবে, যেখানে প্রতি বছর জিপিএ-৫ পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতেন না। সেই চিত্র এবং ভর্তিযুদ্ধের প্রতিযোগিতা এবার খুব একটা থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এবার ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। এ বছর গত বছরের তুলনায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা রেকর্ড-সংখ্যক কমেছে। এর মধ্যে পাসের হার গত বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কমেছে। একই সঙ্গে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪। এর আগে ২০২৪ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করেছিল ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ শিক্ষার্থী। পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮। ওই বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, এবার এইচএসসি ও সমমানের উত্তরপত্র যথাযথ মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও হিসাববিজ্ঞান পরীক্ষায় খারাপ ফল এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে এবার ফল বিপর্যয় হয়েছে। ২০০৪ সালের পর এই প্রথম এইচএসসির ফল এত খারাপ হয়েছে। ওই বছর পাসের হার ছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পরের বছর ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। মূলত ওই বছর থেকেই পাসের হার বাড়তে শুরু করে।
স্নাতক ও সমমান পর্যায়ে আসন শূন্য থাকবে ১০ লাখ ৮০ হাজার
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ মিলিয়ে অনার্স ও সমমান পর্যায়ে ১৮ লাখ ৭ হাজার ৫৭৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে এইচএসসি ও সমমান পর্যায়ে উত্তীর্ণ ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন শিক্ষার্থীর সবাই ভর্তি হলেও ১০ লাখ ৮০ হাজার ৬১৬টি আসন ফাঁকা থাকবে।
ইউজিসির তথ্যমতে, ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে আসন ৫০ হাজার ৪৪৫টি, সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন রয়েছে ৪ হাজার ৩৫০টি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৩৪০টি, সরকারি ডেন্টাল কলেজে ৫৪৫টি, বেসরকারি ডেন্টালে ১ হাজার ৩৫০ জন, আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজে ৩৫০টি, ১০৭ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স কোর্সে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৯৯টি, পাসকোর্সে ১ হাজার ১৬০টি, ঢাকার সরকারি ৭ কলেজে ২৩ হাজার ৬৩০টি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোয় স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান), স্নাতক কারিগরি/সমমান পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি কলেজে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৯৫টি, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ৬৪ হাজার ৫২৯টি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ হাজার ৫৯৩টি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৭২০টি, টেক্সটাইল কলেজে ৭২০টি, মেরিন কলেজে ৬৬০টি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে ৩ হাজার ৭৯০টি, আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০০টি, নার্সিং ও মিডওয়াইফারিতে ৫ হাজার ৬০০টি আসন রয়েছে।
ইউজিসিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়া। এবার এসব প্রতিষ্ঠানে আসন রয়েছে ৫৫ হাজার ৩৫০টি। এর বাইরে কিছু শিক্ষার্থী ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত বিষয়ে পড়তে উন্মুখ হয়ে থাকেন। ফলে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কম জিপিএ নিয়েও অনেকে পাবলিকে ও ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিছু মেডিকেল কলেজ, ঢাকার সরকারি সাত কলেজ, ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনেক ভালো সরকারি বা এমপিওভুক্ত কলেজ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৬ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। তারা সবাই ভর্তি হলে শিক্ষক অবকাঠামোসহ নানা জোড়াতালি দিয়ে চলা অনেক প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ শিক্ষার্থীর সংকটে ভুগবে।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম ফায়েজ বলেন, প্রতিবারের মতো এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির প্রতিযোগিতা থাকবে। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন না, তারা কারিগরি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবেন। তবে পাসের সংখ্যা কম থাকায় মানহীন অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীর সংকটে পড়বে।