- বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা
- সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় পর আগুন নিয়ন্ত্রণে
- সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল ফ্লাইট চলাচল, রাত ৯টায় চালু
- অনুমতিসংক্রান্ত জটিলতায় ফায়ার সার্ভিস ঢুকতে বিলম্বের অভিযোগ
- আগুনের শিখা আর কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় চারপাশ
রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটেছে। গতকাল শনিবার দুপুর আড়াইটা নাগাদ আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের শিখা আর ঘন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় আশপাশের আকাশ। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশনের মোট ৩৭টি ইউনিট ও সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিটও কাজ করছে বলে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর, যোগ দেয় নৌবাহিনীও। দুই প্লাটুন বিজিবিও বিমানবন্দরে কাজ করেছে। এদিকে অগ্নিকা-ের ঘটনায় দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তীতে রাত ৯টার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণের কথা জানানো হয়। এ ছাড়াও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ গতকাল রাত ৮টা ৪০ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিবৃতিতে জানায়।
এদিকে রাত ৯টায় শাহজালালে বিমান চলাচল শুরু হয় বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এদিকে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ভোগান্তির অন্ত ছিল না। ঢাকামুখী বেশ কয়েকটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাশাপাশি কলকাতায় অবতরণ করে। এ ছাড়া, মাঝপথ থেকে ফিরে গেছে অনেক কার্গো উড়োজাহাজ বলে জানা গেছে। আগুন নেভাতে গিয়ে আনসারের ২৫ জন ও ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্যসহ অনেকে আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহতদের সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া, কার্গো ভিলেজে থাকা অনেক মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানান সেখানকার কর্মচারীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে কার্গো ভিলেজ। আগ্নিকা- ঘটেছে আমদানির কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। এটির অবস্থান বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশে। এই গেটকে বলা হয় হ্যাঙ্গার গেট। আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের গেট আছে ৩টি। আগুন লাগে কমপ্লেক্সের উত্তর দিকে, ৩ নম্বর গেটের পাশে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কার্গো কমপ্লেক্সের কুরিয়ার গুদামে আগুনের সূত্রপাত। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গেলেও অনুমতিসংক্রান্ত জটিলতায় ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে বিলম্ব হয়।
এদিকে আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এ সময় তিনি অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, যত দ্রত সম্ভব বিমানবন্দর চালু করা হবে।
কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় বাইরে জমে যায় উৎসুক জনতার ভিড়। মাইকিং করে তাদের সরে যেতে অনুরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনাস্থলের শৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করেন। এ ছাড়া মোতায়েন করা হয় দুই প্লাটুন বিজিবি। এ সময় বিমানবন্দরে প্রবেশের পথগুলো বন্ধ রাখা হয়। ফলে ঢাকার মূল অংশ থেকে উত্তরাগামী সড়কে দেখা দেয় ব্যাপক যানজট।
ফায়ার সার্ভিস ও বিমান বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। আগুনের শিখা আর কালো ধোঁয়ায় আশপাশের আচ্ছন্ন হয়ে যায়। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে আগুনের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ২টা ৩৪ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরের দিকে রওনা হয় চারটি ইউনিট। আগুন বাড়তে থাকলে একে একে ঘটনাস্থলে ৩৭টি ইউনিট পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয়। প্রায় সাত ঘণ্টার প্রচেষ্টায় রাত ৯টার পর কার্গো ভিলেজে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। পাশাপাশি রাত ৯টায় বিমান চলাচলও শুরু হয়।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের মুখপাত্র মো. মাসুদুল হাসান মাসুদ গতকাল সন্ধ্যায় জানান, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফ্লাইট চলাচল সাময়িক স্থগিত রয়েছে। কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার পর উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িক স্থগিত রাখা হয়েছে। এ পর্যন্ত আটটি ফ্লাইট ডাইভার্ট হয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। সিলেটে নেমেছে একটি, কলকাতাতেও গেছে একটি।
কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু সাংবাদিকদের জানান, শনিবার সরকারি ছুটির দিনে দুপুর ২টা পর্যন্ত কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম চলে। সেখানে তখনো অনেক শ্রমিক ও আনসারসহ লোকজন ছিলেন। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয়, এই গুদামে গোলাবারুদসহ রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে; বিস্ফোরণ ঘটতে পারে; সবাই সরে যান। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা কাজকর্ম চলে। এ কারণে এক শিফটের কর্মীরা আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী শিফটে যাদের আসার কথা ছিল, তাদের অনেকে তখনো ঢোকেননি। আবার সারা দিনের শিফটে যাদের কাজ করার কথা ছিল, তাদের তখন দুপুরের খাবারের বিরতি চলছিল। এ কারণে আগুন লাগার সময় সেখানে এয়ারলাইন্স ও এজেন্টদের কর্মী কম ছিল।
খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু আরও বলেন, কুরিয়ার গুদামের একপাশে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। দেশের পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য আনা অনেক রাসায়নিক আকাশপথে আমদানি করা হয়। তিনি দাবি করেন, ‘আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর ফটকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিলেন না।’
জানা গেছে, আমদানির কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে উড়োজাহাজ পার্কিং করার ১০ থেকে ১৪ নম্বর বে। আগুন লাগার পর সেখানে রাখা কয়েকটি উড়োজাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানান বিমানের কর্মীরা। কুরিয়ার সেকশনে থাকা বিমানের কর্মীরা বলেন, কুরিয়ার সেকশনের সেডের বাইরেও অনেক মালামাল উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে রাখা হয়েছিল; সেগুলোও পুড়ে গেছে।
উড়োজাহাজ থেকে মালামাল ওঠানো-নামানোয় যুক্ত থাকা কোম্পানি ভয়েজার এভিয়েশনের গাড়িচালক মো. রাসেল মোল্লা বলেন, আগুন লাগার সময় তার গাড়িটি আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের ১০০ মিটারের মধ্যে ছিল। তিনি সেখান থেকে গাড়িটি দ্রুত সরিয়ে নেন। এ সময় ভেতরে থাকা মানুষদের বের করে দেওয়া হয়।
বিমানবন্দর দিয়ে সাধারণত তুলনামূলকভাবে কম ওজনের যন্ত্রপাতি, পচনশীল পণ্য, ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। আগুনের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এখনো জানা যায়নি। তবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা করেছেন আমদানিকারকেরা।
আকাশপথে পণ্য পরিবহনকারী আরএমকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান ইবনে আমিন সোহাইল সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় আমদানিকারকদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বোঝা যাবে, ক্ষয়ক্ষতি কত হয়েছে কিংবা কবে নাগাদ আবার কার্গো ভিলেজ চালু করা যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, ‘বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আমরা ধারণা করছি। এয়ার এক্সপ্রেস ইউনিট পুরোপুরি পুড়ে গেছে।’
বিমানবন্দরের সিঅ্যান্ডএফের (কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এক কর্মচারী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কার্গোর সব কাপড়চোপড় ও কেমিক্যাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগামী কয়েক মাস হয়তো আমরা কোনো কাজই করতে পারব না।’
বিমানবন্দরে আহত ২৫ আনসার সদস্য : বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী উপপরিচালক ও গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকউজ্জামান জানান, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দায়িত্বে নিয়োজিত আনুমানিক এক হাজার আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। এ সময় কর্তব্যরত অবস্থায় এখন পর্যন্ত ২৫ জন আনসার সদস্য আহত হন, যাদের দ্রুত সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত পারি এয়ারপোর্ট (বিমানবন্দর) চালু করব। কারণ আপনারা জানেন, এয়ারপোর্টে এই মুহূর্তে বিমান ওঠানামা বন্ধ আছে। আমরা চেষ্টা করছি যে, যত দ্রুত পারি আজকে রাতের মধ্যে ফ্লাইট ওপেন (চালু) করব।’
বিমান উপদেষ্টা বলেন, ‘আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আমাদের ইমিডিয়েট লক্ষ্য হচ্ছে অপারেশনকে কত দ্রুত আমরা চালু করতে পারি। বিমানবন্দরের চলমান কার্যক্রমকে কীভাবে আমরা চলমান রাখব, সে ব্যাপারে পদ্ধতিগতভাবে সবাই এখনই বসছি, বসে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এই মুহূর্তে দরকার হচ্ছে সংকটকে অতিক্রম করা। আপনাদের (সাংবাদিকদের) মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে আমরা দোয়া চাইছি। যেন আল্লাহতায়ালা আমাদের এই কাজকে সহজ করে দেন।’
তিনি বলেন, ‘আগুন নেভাতে গিয়ে আমাদের ফায়ার ব্রিগেডের কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সম্পদ রক্ষার জন্য আগুন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনো যথেষ্ট পরিমাণ আগুন রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা দেখছি।’
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। আগুনে কেউ হতাহত হয়েছে এমন সংবাদও আমাদের কাছে আসেনি।