** স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান তারেক রহমানের
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা- নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে গত এক দশকে এই বিমানবন্দরে একাধিকবার আগুন লাগলেও সতর্ক হননি সংশ্লিষ্টরা। গতকাল শনিবার ফের আগুন লাগার ঘটনায় বিষয়টি আবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, এটি ‘স্যাবোটাজ’ হতে পারে। আবার শর্ট-সার্কিটের মাধ্যমে অন্তর্ঘাতী নাশকতাও হতে পারে। পাশাপাশি এখানে রয়েছে একাধিক চুরির ঘটনাও। আবার সম্প্রতি এক কাস্টমস কমিশনারকে রদবদলের ঘটনাটিও বিশ্লেষণ করা উচিত বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে আগুন লাগার পর বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হলেও রাত ৯টা থেকে ফ্লাইট কার্যক্রম ফের চালু হয়। বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অন্যদিকে আগুনের কারণে রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখ বিমানবন্দর সড়কে সৃষ্টি হয়ছে তীব্র যানজট। আগুন লাগার পর থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে যানজটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন বিদেশগামী যাত্রীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট সংলগ্ন কার্গো ভিলেজ হাউসে প্রথমে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিস্ফোরণ হতে থাকে এবং ব্যাপকভাবে জ্বলে ওঠে পুরো এলাকা। নিমেষেই পুড়ে শেষ হয়ে যায় হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানিপণ্য। প্রত্যক্ষদর্শী, সিভিল অ্যাভিয়েশন ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র মতে, প্রথমে আগুনের সূত্রপাত ঘটে কার্গো ভিলেজ হাউসের শর্ট-সার্কিট থেকে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এ ছাড়া, সিভিল অ্যাভিয়েশন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। আগুনের উৎস ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কিছু জানানো হয়নি।
বারবার বিমানবন্দরে আগুন, সতর্কতা ও সন্দেহের তীর সংশ্লিষ্টদের দিকে:
প্রত্যক্ষদর্শী খালিদ হোসেন জানান, এখানে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের মদদ রয়েছে। তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মাল আত্মসাৎ করে গোডাউন থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আশা করি, সুষ্ঠু তদন্তে বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য। জাহাঙ্গীর নামের আরেক ব্যক্তি জানান, বিমানবন্দরে যারা কর্মরত ছিলেন তারা সবই চোর, তাই গজব পড়ছে মনে হচ্ছে। জোবায়ের আহমেদ জানান, বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ আধুনিক যুদ্ধবিমান ক্রয়ের পরিকল্পনা নেওয়ার পর থেকে সব জায়গায় আগুন লাগিয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করার চক্রান্ত হচ্ছে। মাসুম নামের আরেক ব্যক্তি জানান, এখানের আগুন হলো “স্যাবোটাজ”। এটি অন্তর্ঘাত আগুন। তা ছাড়া এখানে সরকারের একটি বাহিনীর গোলাবারুদ ও বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ছিল। সেটাও পুড়ে শেষ হয়ে গেল। এটা অবশ্যই নাশকতার আগুন ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। তিনি জানান, কিছুদিন আগে এখান থেকে এক কমিশনারকে বদলি করা হলো। সেই সঙ্গে আগুন ছোট অবস্থায় থাকতে পাশে থাকা ফায়ার সার্ভিস আসতে ৫ থেকে ১০ মিনিট দেরি হলো। কাজেই বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাচ্ছে, এতে আমাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতা রয়েছে।
এক যুগে শাহজালাল বিমানবন্দরে একাধিকবার আগুন
বিমানবন্দরে ডিউটিরত একাধিক কর্মকর্তরা ও কর্মচারী জানান, গত এক যুগে শাহজালাল বিমানবন্দরে একাধিকবার আগুনের ঘটনায়ও সতর্ক হননি সংশ্লিষ্টরা। এক পাইলট রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিমানবন্দর গত এক দশকে একাধিকবার আগুনের ঘটনায় আলোচনায় এসেছে। কিন্তু আমরা সতর্ক হয়নি। ইমরান আলী নামের এক কর্মচারী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিমানবন্দরে এমন পুনরাবৃত্তির ঘটনার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন করে উদ্বেগ। গোয়েন্দা নজরদারি ও সতর্ক থাকতে দেখা যায়নি সিভিল অ্যাভিয়েশনকে।
সূত্র মতে, এর আগে ৫ এপ্রিল ২০১৩ সাল। বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনের কুরিয়ার সার্ভিস অংশের একটি গুদামে আগুন লাগে। সেই সময়, ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট টানা দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। সেই রিপোটেও ভালো কিছু উঠে আসেনি। এরপর ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ সাল। সকালে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তার দপ্তরে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে অগ্নিকা- ঘটে। সৌভাগ্যবশত দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলায় বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো যায়। এ ছাড়া ১১ আগস্ট, ২০১৭ সাল। বিমানবন্দরের মূল ভবনের ২ নম্বর টার্মিনালের তৃতীয় তলায় আরেকটি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার অফিস থেকে। এদিকে সবশেষে, ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালে দুটি তেলবাহী ট্যাংকারে আগুন ধরে যায়। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ফোমসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে প্রায় ৪০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। নতুন করে গতকালের আগুনের ঘটনায় ঘটনায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিতে নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি রয়েছে কি না।
বিমানবন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান তারেক রহমানের
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তারেক রহমান অগ্নিকা-ের ঘটনায় একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকা-ের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য আমার দোয়া রইল এবং আমি আশা করি সবাই নিরাপদে আছেন।’ জনসেবার প্রতি সত্যিকারের নিষ্ঠা প্রদর্শন করে দ্রুত এবং সাহসের সঙ্গে অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যদের প্রশংসা করেন তিনি। তারেক রহমান মিরপুর এবং চট্টগ্রাম ইপিজেডের কারখানায় অগ্নিকা-ের কথা উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘সম্প্রতি অগ্নিকা-ের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঘটনার কারণ নির্ণয় এবং ভবিষ্যতের জন্য জননিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত করা অপরিহার্য।’
ফ্লাইট বাতিল, ভোগান্তিতে যাত্রীরা:
আগুনের ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের কুয়েতগামী একটি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আটটি ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণের পরিবর্তে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ ছাড়া একাধিক ফ্লাইট আকাশ থেকেই দেশ-বিদেশের অন্য বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিকেল পৌনে ৪টার দিকে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের মুখপাত্র মো. মাসুদুল হাসান মাসুদ কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার পর উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িক স্থগিত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বিমানবন্দর সূত্র বলছে, বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ২৬৭ জন যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট কুয়েতের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। যাত্রী, কেবিন ক্রু ও পাইলটরাও বিমানে উঠে বসেছিলেন। একাধিক যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ অবস্থায় বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে বিমানবন্দরে এসে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারা। অনেকেই বুঝতে পারছেন না তারা কী করবেন।
আমিরুল নামের এক যাত্রী বলেন, আগুনের কারণে এখন চেকিং বন্ধ রয়েছে। কী করব, কী হবে আমাদের কপালে কিছুই বুঝতে পারছি না। আরেক যাত্রী ফারুক হোসেন বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এমিরেটস এয়ারলাইনসের ইকে ৫৮৭ আমার ফ্লাইট ছিল। সেই ফ্লাইট রাত ৩টায় করা হয়েছে। পরিবার নিয়ে এখন কোথায় যাব। আনসার সদস্যরা কোনো সাহায্যও করছেন না। এতে পরিবার নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা। এ ছাড়া হিমালয় এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট ১৮০ জন যাত্রীসহ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণের কথা ছিল। পরে সেটাকে নেপালে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দুবাই থেকে ছেড়ে আসা এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট করাচি বিমানবন্দরে পাঠানো হয়েছে। চেন্নাই থেকে ছেড়ে আসা ইন্ডিগোর একটি ফ্লাইট কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়েছে। শারজাহ থেকে ছেড়ে আসা এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পাঠানো হয়েছে।
বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজট:
আগুনের কারণে রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখ বিমানবন্দর সড়কে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন লাগার পর থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই এই ব্যস্ততম সড়কে দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে। সেখানে বিমানবন্দরের পরিস্থিতির কারণে এই যানজট আরও তীব্র হয়েছে।
গতকাল দুপুরে আগুন লাগার পর থেকে বনানীর কাকলি থেকে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কার্যালয় পর্যন্ত পুরো সড়কে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। সড়কে আটকে পড়া অনেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হেঁটে রওনা দিয়েছেন।
বিমানবন্দরের দুটি প্রবেশ গেট বন্ধ থাকায় কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারছেন না। এতে সময়মতো টার্মিনালে পৌঁছানো নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। যানজটে আটকে থাকা যাত্রীরা জানাচ্ছেন, সাধারণত ১৫-২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। ফলে বিমানযাত্রী ও সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছেন।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে সড়কে গাড়ির জট থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিএমপির ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এস এম হাসিবুর রহমান বাবু। তিনি জানান, বিমানবন্দরে আগুন লাগার কারণে এই সড়কে গাড়ির জট তৈরি হয়েছে। এ কারণে বিমানবন্দর এলাকায় গাড়িগুলোকে ঢুকতে দেয়ো হচ্ছে না।
তিনি জানান, অনেকের সঙ্গেই চারজন-পাঁচজন করে মানুষ আসে। তাই আপাতত প্রধান সড়কে নামতে হচ্ছে ও মালামাল নামাতে হচ্ছে। ফলে সড়কে একটু গাড়ির চাপ রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমের ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপ ঘুরে দেখা গেছে, ওই পথে চলমান থাকা একাধিক যাত্রী বিভিন্ন ছবি পোস্ট করে যানজটের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি তদন্তের পর জানা যাবে:
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানিয়েছেন, তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পরেই অগ্নিকা-ের কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয়। এ ঘটনায় ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মহিদুল ইসলাম বলেছেন আমরা যেটা দেখেছি, আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ ও তদন্তের পর জানা যাবে।