ঢাকা রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

আইনি ভিত্তি পেলেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে এনসিপি

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৫, ১২:১১ এএম

প্রতীক্ষিত জুলাই সনদ স্বাক্ষর হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। কারণ উল্লেখ করে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানিয়েছেন, জুলাই সনদের আইনিভিত্তি না থাকায় এবং বাস্তবায়নের সঠিক পন্থা না দেখানোয় জুলাই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যায়নি এবং স্বাক্ষর করেনি এনসিপি। তবে জুলাই সনদের আইনিভিত্তি পেলে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত তারা। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা জানিয়েছেন, ঐকমত্য কমিশন আলোচনায় ডাকলে সাড়া দেবে দলটি। 

দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষর কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। তিনি জানান, এটা আমরা এর আগেও বলেছি। আবারও পুনর্ব্যক্ত করেছি। যদি এর (জুলাই সনদ) কোনো আইনি ভিত্তি না হয়, এর মূল্য, এর কোনো অর্থ তৈরি হবে না। ফলে আমরা এই আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিইনি এবং যদি এর আইনি ভিত্তি তৈরি না হয় এটার কেবল আনুষ্ঠানিকতাও থাকবে না, এটি একটি গণপ্রতারণা এবং জাতির সঙ্গে একটি প্রহসন হবে।’

জুলাই সনদের গুরুত্ব এবং পূর্বের ইতিহাস তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন,  ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও তিন দলের জোটের যে রূপরেখা, সেই রাজনৈতিক সমঝোতা রক্ষা করা হয়নি। সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিবর্তন করতে চাইলে আইনি ভিত্তি প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘এই ৭২ এর সংবিধান যাতে পরিবর্তন না হয়, পুরোনো ফ্যাসিস্ট কাঠামো যাতে রয়ে যায়-তার জন্য নানা অপচেষ্টা কিন্তু দেশের ভেতরে, দেশের বাইরে থেকে করা হচ্ছে।’

বিগত ফ্যাসিস্ট কাঠামোর সুবিধাভোগীদের চাপের কারণে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল আপস করেছে বলে মন্তব্য করেন এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম। ফ্যাসিস্ট কাঠামো টিকিয়ে রাখতে, অক্ষুণœ রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং আরও কিছু রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার চাপেই কিন্তু সরকার এই ঐকমত্য কমিশন গঠন, সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা এবং জুলাই সনদ পর্যন্ত, এত দূর এসেছে।

৯০-এর পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে দেখতে চান না বলে জানান নাহিদ। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আমাদের এই উপলব্ধি ছিল যে আমাদের লড়াইটা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয় কেবল, একটা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে এই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যেভাবে প্রতারণা করা হয়েছিল, গণঅভ্যুত্থানকে জনগণের আকাক্সক্ষাকে যেভাবে জাতীয় নেতারা এবং সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলো পকেটভর্তি করেছিলÑ আমরা এবার সেটা হতে দেব না।

জুলাই সনদ প্রসঙ্গে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদের আইনিভিত্তি না থাকায় এবং বাস্তবায়নের সঠিক পন্থা না দেখানোয় জুলাই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যায়নি এবং সাক্ষর করেনি এনসিপি। তবে ঐক্যমত কমিশন আলোচনায় ডাকলে তাতে সাড়া দেবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছে দলটি। একইসাথে দলটির শির্ষনেতারা মনে করছেন তারা সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংগ্রহণ না করার মাধ্যমে ইতিহাসের সঠিক পাশে রয়েছে। বরং অনুষ্ঠানে যারা গেছেন তারা গণঅভ্যুত্থান ও জনগণ থেকে ছিটকে গেছেন বলেও মনে করেন তারা।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে আখতার হোসেন বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি ও বৈধতা নিশ্চিত না করেই এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতিকে পরিষ্কার ধারণা না দিয়েই সরকার অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছে। জুলাই সনদের কোনো আইন ভিত্তি না দেওয়া, বাস্তবায়ন আদেশ প্রকাশ না করা এবং পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা জাতির সামনে না আনার কারণে আমরা আনুষ্ঠানিকতার জন্য স্বাক্ষর থেকে বিরত থেকেছি।

তিনি অভিযোগ করেন, ‘জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আহত ও শহিদ পরিবারের প্রতি অসম্মান করা হয়েছে। শহিদ পরিবাররাই জুলাই সনদ আয়োজনের মূল আকর্ষণ হলেও, তাদের মঞ্চ থেকে দূরে বসিয়ে অমর্যাদা করা হয়েছে। শহিদ পরিবার অনুষ্ঠানে প্রাপ্য সম্মান পাননি, বরং প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করা হয়েছে। আহতদের ওপর হামলা চালিয়ে এবং অসম্মান করে জুলাই সনদকে পাওয়ার এলিটের সেটেলমেন্ট বানানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জাতিকে ধোঁয়াশায় রাখা হয়েছে এবং সনদের আইনি ভিত্তি হিসেবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’র উল্লেখ নেই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী যেকোনো বন্দোবস্তের নৈতিক ও আইনি ভিত্তি থাকতে হবে, কিন্তু সনদে জনগণের সার্বভৌম ও গাঠনিক ক্ষমতার মৌলিক সত্যের উল্লেখ নেই।’

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনুভা জাবিন বলেছেন, আমরা টেবিলের এই পাশে, যে পাশে জনগণ, যে পাশে গণঅভিপ্রায়। আমরা হয়তো একা, কিন্তু আমরা ইতিহাসের সঠিক পাশে। তাসনুভা জাবিন বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্রদের বাইরে রেখে সবার সেনাবাহিনীতে যাওয়া, বিপ্লবী সরকার না করা, রাষ্ট্রপতিকে না সরানো, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে না করা, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধে, আয়নাঘরসহ গুম খুনে জড়িত সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে দায়সারা অজুহাত ।

তিনি বলেন, সব ব্যর্থতা ছাত্র উপদেষ্টাদের দেওয়া, সামরিক বেসামরিক আমলা, স্থানীয় প্রশাসন, আদালত, গণমাধ্যম, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবখানে পুরোনো বন্দোবস্তের শক্ত খুঁটি, ছাত্রনেতাদের ব্যক্তিগত বক্তব্য, ফেসবুক পোস্ট, খাওয়া দাওয়াকে ফৌজদারি অপরাধের মতো ম্যাগনিফাই করে দেখানো। দলের নেতা-কর্মিদের যেকোনো অপরাধে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগকে জাতীয় পর্যায়ে ট্রেন্ডিং রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এর গত শুক্রবার এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘এনসিপি জুলাই সনদকে স্রেফ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল কিংবা ফাঁকা প্রতিশ্রুতি মনে করে না। এনসিপি মনে করে, জুলাই সনদের প্রধানতম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মূল এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এ কারণে এই সনদের সুস্পষ্ট আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি থাকতে হবে বলে এনসিপি মনে করে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেখার পর সনদে সই করবে বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।