উপদেষ্টা কমিটিতে সদ্য অনুমোদনপ্রাপ্ত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থায় যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। রূপালী বাংলাদেশের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ এমন আভাস দেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার সরকারকে বলার চেষ্টা করেছি, নগর উন্নয়নের নামে এসব স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করুন। সরকার যদি আমাদের কথা ফাইনালি অগ্রাহ্য করে, তাহলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। আমরা অলরেডি আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছি।’
ড. আদিল বলেন, ‘আমরা সরকারকে এ-ও বলেছি, এভাবে ফার বাড়ানো যায় না, এটি স্বেচ্ছাচারিতা।’ সংস্কার মানে ভালো, এ ক্ষেত্রে সংস্কার মানে বন্ধ যোগ করেন ড. আদিল মুহাম্মদ। তিনি বলেন, এই ড্যাপ সংশোধনী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে করা হয়েছে। পরিকল্পনাবিদদের পরিকল্পনা এখানে পুরোপুরি অকার্যকর। এদিকে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) মধ্যে এখনো কম-বেশি অসন্তুষ্টি রয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় কেমন যেন বেসুরো ঠেকছে সবার কাছে। রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী আব্দুল লতিফের সঙ্গে রূপালী বাংলাদেশর আলাপচারিতায়ও এমন বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রকৌশলী লতিফ বলেন, ‘ফার যৌক্তিক নয়। ঘনত্ব নিয়েও সদস্যদের মাঝে হতাশা রয়েছে। আইনকানুন এভাবে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’ রিহ্যাবের সহসভাপতি বলেন, আগামী পঞ্চাশ সালে ঢাকা মহানগরীর অবস্থা কী হবে, তা মাথায় রেখে সেই আলোকে নগর উন্নয়ন হতে হবে, পরিকল্পনাটা দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে, সেটি হয়নি। তিনি বলেন, জনসংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে, তাদের জায়গা করে দিতে হবে- পরিকল্পনা হওয়া উচিত সেভাবেই।
সংশোধিত ড্যাপে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা হয়েছে, এমন অভিযোগের উত্তরে প্রকৌশলী লতিফ বলেন, দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, একে অপরের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। একজন ব্যবসায়ী যদি লাভ না করেন, তাহলে তিনি টিকে থাকবেন কীভাবে? তিনি শেষ করেন এভাবে, এই ড্যাপ মন্দের ভালো, অন্তত অচলাবস্থা কেটেছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়া গেছে।
এসব অভিযোগ সামনে রেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে ২৩ অক্টোবর কথা হয় রূপালী বাংলাদেশের।
তিনি স্পষ্টত এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশ বিবেচনায় এর চেয়ে উত্তম কিছু হতে পারে না। পরিবেশ রক্ষায় যতটুকু বিবেচনা করা যায়, করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশকে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করে আকাশ-কুসুম কল্পনা করলে তো হবে না, ভাবনা হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে।’
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, অযাচিত দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আমাদের একটা জায়গায় আসতে হবে, সবার স্বার্থ আমাদের দেখতে হবে। ব্যবসার পাশাপাশি দেখতে হবে পরিবেশের বিষয়টিও। ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, সরকার একা কিছু করেনি। প্ল্যানার্স, আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার, বেলা ও রিহ্যাবসহ সব অংশীজনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে উপদেষ্টা কমিটি সংশোধিত ড্যাপের অনুমোদন দিয়েছে। যেসব বিষয়ে তাদের দ্বিমত ছিল, সেগুলোও নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। তার পরও কোথাও কোনো অসংগতি থাকলে তা রিভিউর সুযোগও রয়েছে। এ জন্য একটি টিম করা হচ্ছে, সেখানে প্ল্যানার্সসহ সবাই থাকবেন। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রিভিউ অবারিত থাকবে।
তিনি বলেন, ‘এমনিতে সময় অনেক গড়িয়েছে। প্ল্যান পাসসহ সব কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। আমরা আর ভূমি মালিকদের ক্ষতির কারণ হতে পারি না।’
উল্লেখ্য, বিগত ১৯ মার্চ, ২০২৫ তারিখে ড্যাপ রিভিউ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে তা যাচাই-বাছাই করে পুনরায় উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনার আলোকে রাজউক ও মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কম করে হলেও ৩৫ সভা করে উপস্থাপন করা হলে ড্যাপের এই চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদিত হয়।
সংশোধিত ড্যাপে ঢাকাকে আগেকার ২৭৫টি জনঘনত্ব ব্লকের পরিবর্তে ৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। গাজীপুরের অংশ বাদ দিয়ে নতুন পরিকল্পনায় ঢাকাকে ১ হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এতে ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর পাশাপাশি সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় ভবনের উচ্চতা সীমা বাড়ানোর বিধান রয়েছে। একই সঙ্গে খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০২৫’-এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা কমিটি।
২০২২ সালে গেজেট প্রকাশের পর এক দফা সংশোধন আনা হয়েছিল। কিন্তু আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বারবার ঢাকায় ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ সংশোধনীতে ভবনের উচ্চতা ও জনঘনত্ব বাড়ানো হয়েছে বলে বিভিন্ন বিশ^াসযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
রাজউক সূত্র জানায়, ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) সংশোধনে যেসব বিষয়ের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় ভবনের উচ্চতাসীমা বৃদ্ধি, মুখ্য ও সাধারণ জলস্রোত একীভূত করে ‘বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল’ ঘোষণা (যেখানে কোনো ধরনের স্থাপনা করা যাবে না) এবং ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে অন্তত ৫০ শতাংশ এলাকা খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য সংরক্ষণ।
বিশেষ করে কেরানীগঞ্জ, সাভারের হেমায়েতপুর, নারায়ণগঞ্জের কাশিপুর, রূপগঞ্জের কাঁচপুর, ভুলতা ও গাউছিয়া এলাকায় আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ থাকছে।
এদিকে খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৫’-এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে ভবন নির্মাণের পর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট নবায়ন বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন বিধিমালায় একবার সার্টিফিকেট নিলেই তা আজীবনের জন্য কার্যকর থাকবে। পাঁচ কাঠা বা তার বেশি জমির প্লটে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২০০৮ সালের পুরোনো বিধিমালা অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের আবেদন করলেই অনুমোদন ফি দিতে হতো। নতুন বিধিমালায় ভবন নির্মাণের সুপারিশপ্রাপ্তির পর ফি পরিশোধ করতে হবে। আবেদন নিষ্পত্তির সময়ও ৪৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৮০ দিন করা হয়েছে। তবে খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৫’-এ স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বাধ্যতামূলক করায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি আবাসন ব্যবসায়ীরা।
এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা কতটুকু বাড়ল: রাজউক এলাকার প্রায় সব জায়গাতেই ভবনের উচ্চতা বাড়ছে। সংশোধিত ড্যাপ ও খসড়া ‘ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৫’ অনুযায়ী, অনেক স্থানে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগে যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল, এখন সেখানে ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ সম্ভব হবে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো প্লটে যত বেশি খোলা জায়গা রাখা হবে, সে অনুযায়ী ভবনের উচ্চতায় অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো এলাকায় ফার-এর মান ২.৫ হয়, তাহলে ন্যূনতম ফাঁকা জায়গা রেখে ৪-৫ তলা ভবন করা যাবে। কিন্তু জমির মালিক যদি আরও বেশি জায়গা খালি রাখেন, তবে একই মানে ৭-৮ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে।
যেসব এলাকায় ফার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- মিরপুরে ২.৮ থেকে ৩.৪, দক্ষিণ খানে ২ থেকে ৩.১, শেওড়াপাড়ায় ২ থেকে ৩, কড়াইলে ০ থেকে ২, মহাখালীতে ২.২ থেকে ৩.৩, মোহাম্মদপুরে ২.৭ থেকে ৩.৪, পুরান ঢাকায় ২.৬ থেকে ৩.৩, খিলগাঁওয়ে ২ থেকে ৩.৪, টঙ্গীতে ২.৪ থেকে ৩.২, রূপগঞ্জে ২ থেকে ৩.২, সাভারে ২ থেকে ৩.৪, মিরপুর ডিওএইচএসে ২.৫ থেকে ৪.৮ এবং খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় ২ থেকে ৪.৪।
এ ছাড়া বারিধারা, বসুন্ধরা, কচুক্ষেত, উত্তরা, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, ডেমরা, মগবাজারসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যমান ফারের মানের তুলনায় সর্বোচ্চ ১.৫ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শুধু ফারের মানই বাড়েনি, যদি ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে একাধিক প্লট একীভূত করা হয়, তাহলে নির্ধারিত ফারের ওপর অতিরিক্ত ০.২৫ থেকে ০.৭৫ পর্যন্ত বোনাসও পাওয়া যাবে।
রাজউক সূত্রে বলা হয়েছে, মালিকগণ যত বেশি খোলা জায়গা ছাড়বেন, তার প্লটে ভবনের উচ্চতা তত বেশি বাড়বে। ফলে ভবনের উচ্চতা বাড়লেও খোলা জায়গা ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণের সুযোগ বাড়বে।
বেড়েছে ফ্লোর ইউনিটও : ভবনের উচ্চতা বাড়ার পাশাপাশি ফ্লোর ইউনিটের সংখ্যাও বেড়েছে, কিছু কিছু জায়গায় তা দ্বিগুণেরও বেশি। ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রায় সব এলাকাতেই ফ্লোর ইউনিট বা আবাসন ইউনিটের হার বাড়ানো হয়েছে, ফলে ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগও আগের চেয়ে বাড়ছে।
এলাকাভেদে আবাসন ইউনিটের হার মূল ড্যাপের তুলনায় বাড়ানোয় সব এলাকাতেই ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, মূল ড্যাপে পুরান ঢাকায় আবাসন ইউনিটের হার ছিল ১.২, যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে ৩.১ করা হয়েছে। ফলে পুরান ঢাকার পাঁচ কাঠা জমিতে আগে সর্বোচ্চ ছয়টি ফ্ল্যাট করা যেত, এখন সেখানে ১৩টি পর্যন্ত ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগ থাকবে।
সংশোধিত ড্যাপের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণখানে ফ্লোর ইউনিট ১.৪ থেকে বাড়িয়ে ২.৯, মিরপুরে ১.৭ থেকে ২.৯, শেওড়াপাড়ায় ১.৩ থেকে ৩, মহাখালীতে ১.৯ থেকে ৩.২, মোহাম্মদপুরে ১.৭ থেকে ২.৮, পুরান ঢাকায় ১.২ থেকে ৩.১, টঙ্গীতে ১.২ থেকে ৩, রূপগঞ্জে ১.২ থেকে ৩, সাভারে ১.২ থেকে ৩, মিরপুর ডিওএইচএসে ১.৯ থেকে ২.৭ এবং খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় ১.২ থেকে ২.৬ করা হয়েছে।
নতুন বিধিমালায় ইমারত নির্মাণে অতিরিক্ত ভয়েড স্পেস, সেটব্যাক, ভূমি আচ্ছাদন ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে সংশোধন আনা হয়েছে এবং বিল্ডিং কোডের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে স্থাপত্য নকশার পাশাপাশি কাঠামোগত ও অন্যান্য নকশা অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
রাজউকের শীর্ষ মহল জানিয়েছে, সংশোধিত ড্যাপে গ্রিন বিল্ডিং নির্মাণে প্রণোদনা প্রদান, আপিল কমিটি গঠনসহ আরও কয়েকটি নতুন বিষয় সংযোজন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। এদিকে ভবন নির্মাণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে পাঁচ কাঠা বা এর ওপরের আয়তনের জমির জন্য স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) বাধ্যতামূলক করায় নাখোশ অনেকেই। কথা প্রসঙ্গে রিহ্যাব নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা প্রতিবাদ জানাবেন। সব মিলিয়ে সংশোধিত ড্যাপ অনেকের মধ্যেই অম্লমধুর প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।

