** ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শুরু এবং শেষ হলে আশা করছি দেশের জ¦ালানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে : বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৩ নম্বর কূপের সংস্কারকাজ শুরু হয়। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে আগামী ১০ বছরে ২৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছিল পেট্রোবাংলা। এরই ধারাবাহিকতায় একই ক্ষেত্রের ৫নং কূপেও গতকাল শনিবার শুরু হয়েছে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজটি শেষ হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। আর এটি সফলভাবে শেষ হলে বর্তমান উৎপাদনের অতিরিক্ত ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এর বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় গ্যাসের চাহিদা মেটাতে অনুসন্ধান ও উন্নয়নকাজ চালাচ্ছে ১০০টি কূপে। এগুলোর মধ্যে বাহুবল ছাড়াও ৩১টিতে ওয়ার্কওভার (সংস্কার) কার্যক্রম চালানো হবে। ফলে আগামী বছরের শুরুতেই দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে দাবি জ¦ালানি বিভাগের।
চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৩ নম্বর কূপের সংস্কার (ওয়ার্কওভার) কার্যক্রম চালানোর পর নতুন গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। কূপটিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রবাহ ধরা পড়ে বলে তখন জানায় সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। এসজিএফএল ও বাপেক্সের কারিগরি বিষয়ে দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওই কূপের সংস্কারকাজ (ওয়ার্কওভার) সফলভাবে সম্পন্ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৫নং কূপেও শুরু হয়েছে ওয়ার্কওভার কার্যক্রম। আর এখান থেকেও গ্যাস মিলবে অন্তত ১৫ মিলিয়ন গ্যাস। এই কেন্দ্র ছাড়াও সংস্থাটির আওতায় সিলেট-১০এক্স, সিলেট-১১, ডুপিটিলা-১, কৈলাসটিলা-৯, রশিদপুর-১১ ও রশিদপুর-১৩ নম্বর কূপ খনন এবং কৈলাসটিলা-৯ ও বিয়ানীবাজার-২ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভার (সংস্কার) কাজ চলমান বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা। বিগত সরকারের আমলে চাহিদা পূরণে অনেকটাই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে খাতটি। সম্প্রতি চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকায় এখনই আমদানি বন্ধ না করতে পারলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা কূপগুলো খনন ও অনুসন্ধানে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৫ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে অন্তত ১০০টি কূপ অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভারের বড় পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এ সময়ের মধ্যেই প্রকল্পগুলোর কাজ সমাধানেরও তাগিদ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৩ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৯টি কূপের অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। একইসঙ্গে ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্ন হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ১০টি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) ২টি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড ৩টি প্রকল্প বাস্তবায়িত করবে। এর বাইরেও বাপেক্সের নিজস্ব রিগ দিয়ে ২৮টি, বিজিএফসিএলের রিগ দিয়ে ২টি, এসজিএফএলের রিগ দিয়ে ৩টি মোট ৩৩টি কূপ খনন হবে। আর বাপেক্সের মাধ্যমে রিগ ভাড়া করে ১০টি কূপে চলবে খননকাজ। আর আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাপেক্স ১৪টি, বিজিএফসিএল ৭টি, এসজিএফএল ৫টি কূপ খনন করবে। সব মিলিয়ে ৬৯টি কূপের খনন হবে। কূপগুলো ওয়ার্কওভার কার্যক্রমে বাপেক্সের রিগ দিয়ে হবে ১৬টি, বিজিএফসিএলের রিগ দিয়ে ১২টি, এসজিএফএল দিয়ে ৩টিসহ মোট ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার হবে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে তিতাস ফিল্ডে ৫টি কূপের মূল্যায়ন-কাম-উন্নয়ন কূপ খনন করা হবে বাপেক্সে এবং আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে। ২০২৭ সালের মার্চ থেকে ২০২৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে হবিগঞ্জ, বাখরবাদ ও মেঘনা গ্যাস ফিল্ডে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে একইভাবে। ২০২৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দোয়ারাবাজারে ১টি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ, বিয়ানীবাজার-৩ এ ১টি মূল্যায়ন কাম অনুসন্ধান কূপ এবং বিয়ানিবাজারে ৩টি কূপের খনন হবে।
একইভাবে ২০২৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে কৈলাশটিলা-১০, রশিদপুর-১৪ ও ডুপিটিলা-২ খনন করা হবে। এর বাইরে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে একই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বেগমগঞ্জ-৫, বেগমগঞ্জ-৬, সুনেত্র-২ খনন করা হবে। একই এলাকায় ২০২৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সুবর্ণচর-১, নোয়াখালী-১, মতলব-১, সুন্দলপুর-৫ নামের ৪টি কূপের খননকাজ চলবে। সেমুতাং-৭, সেমুতাং-৮, চর লক্ষ্যা-১, মানিকগঞ্জ-১, মোবারকপুর সাউথ ইস্ট-১ নামের ৫টি কূপ খনন হবে ২০২৬ সালের জুন থেকে ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে। ২০২৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে শাহবাজপুর-১, ভোলা নর্থ-৫, শাহবাজপুর-৬, শাহবাজপুর-৮ কূপগুলো খনন করা হবে।
এ ছাড়াও এই তিন বছরে কাসালং-১, পটিয়া-২, সীতাপাহাড়-৩, জলদি-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ নর্থ-১, মদন-১, ধর্মপুর-১, বেগমগঞ্জ-৭, উড়িরচর-২, সন্দ্বীপ সাউথ-১, সন্দ্বীপ নর্থ-১, মোবারকপুর সাউথ, ওয়েস্ট-১, বালিগাঁও-১, দোয়ারাবাজার ইস্ট-১, দোয়ারাবাজার ওয়েস্ট-১, শাহবাজাপুর-১০, শাহবাজপুর-১১, শাহবাজপুর-১৩, শাহবাজপুর সাউথ-১, আলিমাবাদ-১, শাহবাজপুর নর্থ-১, ভোলা ওয়েস্ট-১, শাহবাজপুর নর্থ ওয়েস্ট-১, শেরপুর-১, কোম্পানীগঞ্জ-১, সুনেত্র ইস্ট-১, ঘাটাইল-১, বিশ্বনাথ-১, মদন-২, জামালপুর-২, ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-২, ডাকাতিয়া-১, নোয়াখালী-২, সুবর্ণচর-২, সুবর্ণচর-৩, মতলব-২, মতলব-৩ নামের কূপগুলো খনন করা হবে।
আর চলতি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে তিতাস-১৩, তিতাস-১৫, তিতাস-২২ কূপের ওয়ার্কওভারের কাজ চালানো হবে। এরপর নানা সময়ে বাখরাবাদ-২, বাখরাবাদ-১০, বাখরাবাদ-৩, তিতাস-১৭, তিতাস-১৮, তিতাস-২৫, তিতাস-২০, তিতাস-২৩, তিতাস-২৬, কৈলাশটিলা-৭, রশিদপুর-৭, সিলেট-৯, রূপগঞ্জ-১, হালদা-১, সেমুতাং-৬, শ্রীকাইল-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ-৩, শ্রীকাইল ইস্ট-১, শ্রীকাইল-২, বেগমগঞ্জ-৩, শাহবাজপুর-৩, শাহবাজপুর-১, শাহবাজপুর ইস্ট-১, শাহবাজপুর-২, শ্রীকাইল-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ-৩, ফেঞ্চুগঞ্জ-৪ কূপগুলোর ওয়ার্কওভার করা হবে।
এসব বিষয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘চলমান জ্বালানি সংকট নিরসনে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে জোরদার করার এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় গত বছরের শেষেই। তার ফলও আমরা পাচ্ছি। তবুও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না মেলায় আমদানি অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। তবে বাকি কূপগুলোর ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শুরু এবং শেষ হলে আশা করছি দেশের জ¦ালানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।’
এর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ৪৬টি কূপ ২০২২-২৫ সালের মধ্যে নতুন করে খনন, ওয়ার্কওভারের কথা জানিয়েছিল। একটা সময় গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় সময় সংখ্যা কমিয়ে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে চলতি বছরের মধ্যেই এগুলোর কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এর মাধ্যমে দৈনিক অন্তত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনেরও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও পতিত সরকার এসব কাজে নিজেদের পছন্দমতো কোম্পানিকে কাজ দিতে গিয়ে কোনোটাই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত চেষ্টা করছে। যদি সাফল্য আসে তাহলে দেশের জ¦ালানি খাত অনেকটাই সমৃদ্ধ হবে। কমবে আমদানিনির্ভরতা। যা আমরা বরাবরই বলে আসছিলাম।’
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাচ্ছে বাংলাদেশের।
বাপেক্স বলছে, বর্তমানে দেশে বাপেক্স দৈনিক ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) উৎপাদন করছে ৬১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড উৎপাদন করছে ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সব মিলিয়ে এই তিন কোম্পানি দৈনিক মোট ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। আর বাকিটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শেভরন আর আমদানি করা এলএনজি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন