বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ১২:২২ এএম

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল চলছেই

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ১২:২২ এএম

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর  মিছিল চলছেই

বছর শেষ হতে চললেও থামছেই না ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা। গত সোমবার ছয়জনের মৃত্যুর পর গত ২৪ ঘণ্টায় আরও চারজনের প্রাণহানী ঘটেছে। এ নিয়ে চলতি বছরে এযাবৎ ডেঙ্গুতে মোট ২৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে ১ হাজার ৪১ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৪৬৪। এমন পরিস্থিতিতে নভেম্বরেও ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ চলমান থাকার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনতার গুরুত্ব তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসন যেহেতু ব্যর্থ, তাই ব্যক্তির নিজেকেই ডেঙ্গু মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে। এ জন্য ঘরে যেন পানি জমে না থাকে ও ঘুমের সময় মশারি টানানোর কথা বলছেন তারা।

গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৭৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২০ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২০৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২৩০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৪০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৯ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৫ জন, রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৯ জন এবং সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯ জন রয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৯৯০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। চলতি বছরে এযাবৎ মোট ৬৪ হাজার ৪০৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। মোট আক্রান্তদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ ও ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ নারী রয়েছে।

বছরের শেষ সময়েও ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত গ্রীষ্মকাল ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলতি বছরের অক্টোবরেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। তাই তারা এখন ডেঙ্গুকে সারা বছরের রোগ হিসেবেই চিহ্নিত করছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা শীত-গ্রীষ্ম মানছে না। বছরব্যাপী প্রজনন এবং বংশবিস্তার করছে। এসব কারণেই দেশে এখন ডেঙ্গু সংক্রমণ সারা বছর ধরেই চলছে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে। মশার ঘনত্ব যেহেতু বেড়েছে, তাই বেড়েছে ডেঙ্গুর সংক্রমণও। আমরা দুই মাস আগে থেকে বলে আসছি, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। কিন্তু স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়া ডেঙ্গুর পিক টাইমেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখনই মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ না নিলে নভেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, অতীতে শহরের বাসা-বাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপটাই) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেঙ্গু এখন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। আশঙ্কা করছি, নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকবে, যা আগামী বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চলবে।

এদিকে আবহাওয়ায়ও এসেছে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। আগে অক্টোবরের শুরু থেকেই শীতের আমেজ শুরু হয়ে যেত দেশে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অক্টোবর শেষ হয়ে নভেম্বর শুরু হতে চললেও তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। এ ধরনের আবহাওয়া মশার কামড়ানোর প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জ¦র হলেই ডেঙ্গু হয়েছেÑ এই আতঙ্কে ভোগা যাবে না। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। ঋতু পরিবর্তন বা অন্যান্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও এ সময় বেশি বাড়ে। তাই কারও জ¦র হলেই তা ডেঙ্গু কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

রোগীর রোগের ইতিহাস বা শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অন্যান্য জ¦র থেকে ডেঙ্গুকে সব সময় আলাদা করা সম্ভব হয় না। তাই প্রয়োজন হয় কিছু রক্ত পরীক্ষা। সাধারণত ডেঙ্গুতে জ¦রের একেবারে প্রথম দিন থেকেই রক্তে আবির্ভাব ঘটে একটা নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের। একে বলা হয় এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন। চার-পাঁচ দিনের মাথায় তা কমতে শুরু করে। আবার চার-পাঁচ দিনের মধ্যে রক্তে দেখা দিতে পারে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে জন্মানো অ্যান্টিবডি, যাকে বলা হয় আইজিএম (ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম)। ৯ থেকে ১০ দিনের মাথায় আইজি এম কমে গিয়ে চলে আসে আইজিজি (ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি) অ্যান্টিবডি। এটা দীর্ঘদিন ধরে রক্তে বিরাজ করে। তাই একটি বা দুটি রক্ত পরীক্ষা করলেই ডেঙ্গুর ফলাফল জানা যাবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব পরীক্ষার ফলাফল বদলে যেতে পারে। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই সময়টায় রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করাতে হবে। মাঝে মাঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নেগেটিভ এলেই যে  ডেঙ্গু নেই, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। রক্ত পরীক্ষায় প্রমাণিত না হলেও কিন্তু ডেঙ্গু হতে পারে। মূল কথা, জ¦র হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে সঙ্গে সঙ্গে।

চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কেন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডেঙ্গু বাড়বে এরকম পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। এবার বর্ষা একটু দেরিতে শুরু হয়েছে, তাই ডেঙ্গুর প্রকোপও শুরু হয়েছে দেরিতে। আমরা ভয় পাচ্ছি যে এবার ডেঙ্গুর মৌসুম আরও দীর্ঘায়িত হবে। ডেঙ্গু যে হারে বাড়ছে, সেটা বিপজ্জনক। এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়ে গেলে ডেঙ্গু বাড়বেই, তাই নিজ দায়িত্বে বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও মশা মারতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

এদিকে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর ভিড়। মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট না পেয়ে অনেক রোগী মেঝে, বাথরুমের সামনে ফাঁকা জায়গায় এমনকি সিঁড়ির সামনের খালি জায়গায়ও ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।

রাজধানীর হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। এমনকি অন্যান্য ওয়ার্ডেও রোগী ভর্তি করতে হচ্ছে। একমাত্র ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালটিতেও রোগীর তিল ধারণের জায়গা নেই।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসে ভর্তি হন রওনক আহমেদ। তিনি বলেন, প্রথম দিন জ¦র উঠলে বাসায়ই প্যারাসিটামল খাই। কিন্তু দুই দিনের মাথায় শরীর খারাপ হওয়া শুরু করলে আজ (গতকাল) সকালে হাসপাতালে ভর্তি হতে এসেছি। এখানে আসার পরপরই চিকিৎসকেরা চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন। একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘এলাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশার ওষুধ কোনো দিন দেওয়া হয় না। ফলে দিনে-রাতেই তো থাকে মশার উপদ্রব। চার দিনে জ¦রে শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। রক্তের প্লাটিলেট অনেক নেমে গেছে। তবে চিকিৎসকেরা আন্তরিকভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন।’

ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘এবার গতবারের চেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তবে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার কম হচ্ছে। একটি মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়। তাই আমরা চিকিৎসার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। পরিসংখ্যান এবং হাসপাতাল থেকে যে মৃত্যুর তথ্য পাচ্ছি, তাতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনেই বেশির ভাগ রোগী ৫০ শতাংশের বেশি মারা যাচ্ছে। তার মানে, রোগের যে আক্রমণ হয়েছে, এটা অনেক আগে। রোগীরা হাসপাতালে পরে এসেছে। আমরা হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থাপনার চেষ্টা করছি।’

তিনি আরও বলেন, এখন যেটা সবচেয়ে বড় বিষয়, সেটা হলো জনগণের সচেতনতা। যেহেতু মশা উৎপন্ন হওয়ার বিষয় আছে, সে জন্য মশা ধ্বংসেরও বিষয় আছে। তাদের লার্ভা ধ্বংস করার বিষয় আছে। লোকজন যেন প্রোটেকটেড থাকে, সে জন্য মশারি টানানো খুবই জরুরি। এগুলো হচ্ছে মূলত ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিষয়। এগুলো যদি আমরা অবজ্ঞা করি, তবে ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল। আবু জাফর বলেন, ডেঙ্গু হলেও আমরা প্রথম পর্যায়ে যদি শনাক্ত করতে পারি, ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাসায় বসেই হয় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। সিভিআর পর্যায়ে না গেলে হাসপাতালে যাওয়া জরুরি নয়। এর সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও সচেতনতার অভাব এবং অবহেলার কারণে আমাদের মূলত ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। এর আগের বছর ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!