ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

বিএনপির জোটে আসন বণ্টন নিয়ে অন্তোষে জট

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২৫, ১০:৫০ পিএম
গ্রাফিক্স : রূপালী বাংলাদেশ
  • যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র প্রায় সব দল ১৬৮ জনের প্রার্থী তালিকা জমা দেয় বিএনপির কাছে
  • দুই দফায় ২৭২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা বিএনপির। বাকি রইল ২৮টি
  • আসন সমোঝতা নিয়ে দরকষাকষিতে ঝুলে আছে জোটের ভবিষ্যৎ
  • শরিকদের কারো সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেনি বিএনপি
  • জোটের যোগ্য নেতাদের ভোটের মাঠের লড়াইয়ে দেখতে চায় বিএনপির নেতারা
  • বিএনপি যেসব আসনে ছাড় দেবে তা দ্রুত ঘোষণার তাগিদ মিত্রদের

ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলো জোটের হিসাবে মিলালেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। জোটের সেই হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী ঘোষণার পর দলীয় কোন্দল মেটাতে না পারলেও বিএনপির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ শরিকদের মধ্যে আসন বণ্টন। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার এক মাস পার হলেও, জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত না করায় বিএনপির শরিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। আসন সমঝোতা নিয়ে দরকষাকষিতে ঝুলে আছে জোটের ভবিষ্যৎ। বিএনপি যেসব আসনে ছাড় দেবে সেগুলো দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার তাগিদ মিত্রদের। আর বিএনপি নেতারা বলছেন, প্রার্থী তালিকা দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে। যোগ্যদেরই ভোটের মাঠের লড়াইয়ে দেখতে চান তারা।

বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী, আন্দোলনের মিত্র প্রায় সব দলই তাদের প্রার্থী তালিকা জমা দিয়েছিল অনেক আগেই। সূত্র জানায়, এ সংখ্যা ১৬৮। এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ছাড়া ছয়দলীয় জোটÑ গণতন্ত্র মঞ্চের বাকি পাঁচ দল ৪০ জন, ১২ দলীয় জোট ২১ জন, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ৯ জন, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ১৯ জন, এলডিপি ১৩ জন, গণঅধিকার পরিষদ ২৫ জন, গণফোরাম ১৬ জন, এনডিএম ১০ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ৫ জন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ৬ জন এবং বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) ৪ জনের প্রার্থী তালিকা দিয়েছে। তবে তালিকা জমা নেওয়ার পর শরিকদের কারো সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসেনি বিএনপি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রথম পর্যায়ে ২৩৭ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে গত ৪ ডিসেম্বর আরও ৩৬ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। দুই পর্যায়ে মোট ২৭২ আসনে প্রার্থী নিশ্চিত হয় বিএনপির। ৪ ডিসেম্বর বাকি ২৮ আসন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাকি আসনগুলোয় প্রার্থী যথাসময়ে ঘোষণা করা হবে। আমাদের সমমনা মিত্র যারা আছেন, তাদের এবং দুই-একটা দলীয় প্রার্থীর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সেগুলো আমরা আরও পরে ঘোষণা করব।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫, জাতীয় জোটের নেতা সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫, এলডিপির চেয়ারম্যান ড. অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক চট্টগ্রাম-১৪, দলটির মহাসচিব ড. রেদওয়ান আহমেদ কুমিল্লা-৭, জাতীয় পার্টি (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার পিরোজপুর-১, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের স্ত্রী তানিয়া রব লক্ষ্মীপুর-৪, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম লক্ষ্মীপুর-১, বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা-১৭, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর পটুয়াখালী-৩, দলটির মহাসচিব রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২, এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের জুনায়েদ আল হাবিব ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ এবং গণফোরাম ও গণঅধিকার পরিষদে রাজনীতি করার পর এখন কোনো দলে না থাকা ড. রেজা কিবরিয়া হবিগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। যদিও এসব আসনে এখনো কারো নাম ঘোষণা করেনি বিএনপি। তবে উল্লিখিত আসনে জোটের প্রার্থীরা যে মনোনয়ন পাবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত।

তবে বিএনপিদলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণার মাস পেরোলেও মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে পারেনি দলটি। তাই শরিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ বিরাজ করছে। ভেতরে ভেতরে বাড়ছে ক্ষোভ। এরইমধ্যে বিএনপির জোটবন্ধু যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি হতাশ হয়ে ছেড়েছে সঙ্গ। গত শুক্রবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান দলটির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার গুঞ্জন ছড়িয়েছে ১২-দলীয় জোটের। বৈঠক করে আজ সোমবার ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে দিলেও গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সেই সংবাদ সম্মেলন বাতিলের বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠায় ১২-দলীয় জোট। শরিক দলগুলোর মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে কাজ করছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি।

১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা যেহেতু বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম করেছি। জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিÑ শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। আশা করি, তারা তাদের কথা রাখবেন। এখনো তো অনেক আসন খালি আছে। কেউ কেউ হতাশ হবে, আমরা আশায় বুক বেঁধেছি। এক দিন এখন এক বছরের সমান। আমরা বিব্রত হচ্ছি, বিএনপি যে আসনগুলো ছাড়বে সেগুলো দ্রুত ছেড়ে দেওয়া উচিত।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের বেশকিছু দল এখনো দরকষাকষি করছে। সম্মানজনক সমঝোতার ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হবে বলে আমরা মনে করি। বিএনপির সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের বোঝাপড়া। আশা করি, তারা অবমূল্যায়ন করবে না। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝে নিতে চাই সর্বোচ্চ প্রাপ্যটা। আমাদের প্রত্যাশিত আসন বুঝে না পেলে হয়তো এককভাবে নির্বাচন করব আমরা। সেক্ষেত্রে তিনশ আসনে প্রার্থী দেবে গণঅধিকার পরিষদ।’ 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেসব আসনে শরিক দলের নেতাদের নজর রয়েছে, সে রকম বেশ কয়েকটি আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতিমধ্যে প্রচার শুরু করেছেন, যা জোটের সমন্বয় নষ্ট করছে। যেমনÑ ঢাকা-০৮ আসনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির হয়ে আমার নির্বাচন করার কথা ছিল। এখন দেখছি বিএনপির একজন বড় নেতাকে সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যোগ্য প্রার্থী হলে তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে। যাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের জন্য আসন রেখেছে বিএনপি। শরিকদের মাঝে যে অসন্তোষের কথা বলা হচ্ছে বিষয়টি ঠিক এমন নয়। আমরা কথা বলছি, সবাইকে তো আর খুশি করা সম্ভব হবে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের সমমনা দলগুলোর জন্য কিছু আসন আমরা রেখেছি, এমন নয় যে, সেখানে বিএনপির ভালো প্রার্থী নেই। শরিকদের চাওয়া তো অনেক, আমরা কয়টা তাদের দিতে পারব সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শিগগিরই আলোচনার মাধ্যমে শরিকদের আসন চূড়ান্ত করা হবে।’