রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সংঘটিত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার মাস পূর্ণ হলো আজ। গত মাসের ২১ তারিখে দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী। এ ঘটনার এক মাস পরও শোকের ছায়া পুরো ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে স্কুলে স্বাভাবিক পরিবেশ নেই, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল বুধবার একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলে তারা রূপালী বাংলাদেশকে এসব কথা বলে। এদিকে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির এক মাস আজ পার হলেও গতকাল পর্যন্ত এ দুর্ঘটনার বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশ পায়নি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত হয়েছে মোট ৩৪ জন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক। এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরও ২৪ জন। এর মধ্যে তিনজন শিক্ষক, তিনজন অভিভাবক ও ২৭ জন শিক্ষার্থী।
স্কুলের একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা জানান, এখনো তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্কে আছেন স্থানীয়রাও। দুর্ঘটনার পর থেকে স্কুলে শোকের আবহ বিরাজ করছে এবং স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া এ দুর্ঘটনার শিকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ দুর্ঘটনা শিক্ষার্থীদের মনে সারা জীবনের জন্য দাগ ফেলেছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। এখনো ট্রমার মধ্যে আছে ঘটনাস্থলে থাকা একাধিক শিক্ষার্থী।
আতঙ্কে রয়েছেন অভিভাবকেরা
এক মাস পেরিয়ে গেলেও স্বজনহারাদের বুক ফাটা কান্না থামেনি। প্রতিদিনই হারানো সন্তানদের স্মৃতিতে ভেঙে পড়ছেন তারা। এ ছাড়া যাদের সন্তানেরা এখনো ক্লাস করছে, তারাও রয়েছেন আতঙ্কে। এমনই একজন মোসাম্মৎ শিলা। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করে এখন বিপদে আছি। প্রতিদিন মনে হয় না পাঠাই। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষতি হবে জেনেও বুকে পাথর চাপা দিয়ে পাঠাতে হয়।’ আরেকজন অভিভাবক মোস্তফা কামাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এতগুলো বাচ্চা মারা গেল, কিন্তু প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোচিংয়ের কারণে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, অথচ সেই কার্যক্রম বন্ধ হয়নি।’
এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা এখনো ফিরতে পারেনি স্বাভাবিক জীবনে। প্রতিষ্ঠানটির সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নিহাল জানায়, ‘প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর মাথার ওপর দিয়ে বিমান যায়, তখনই ভয়ে বুক ধড়ফড় করে। লেখাপড়ায় মন বসে না। মনে হয় আবার কোনো বিপদ আসছে। স্কুলে আসতে মন চায় না।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল নাঈম বলে, ‘আকাশ দিয়ে প্লেন গেলে আমার কান্না আসে। আমি খুব ভয় পাই। তবু মা জোর করে প্রতিদিন স্কুলে পাঠায়।’
এ বিষয়ে কথা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা লে. কর্নেল (অব.) নুরুন নবীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মানসিক সেবা স্বাস্থ্য সেন্টার খোলা হয়েছে স্কুলে। স্কুল ঘুরে দেখা গেল শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, অভিভাবকসহ শিক্ষকেরাও এই সেবা নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল জানান, ‘আমরা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীদের মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে কাউনসেলিং কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে।’
ট্রমা কাটাতে সময় লাগবে, ধারণা মনোবিজ্ঞানীদের
মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, শিশুদের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এটি কেবল তাদের শিক্ষা নয়, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক বিকাশকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই নিয়মিত মানসিক সহায়তা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং একটি স্বস্তিকর শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি মাইলস্টোনের শিশুদের সঠিক সহশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক সেবা না দিলে পরবর্তী সময়ে জটিল মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। তাই শিশুকে তার অনুভূতি প্রকাশের নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য উপায় তৈরি করে দিতে হবে।
মেন্টাল হেলথ ফাস্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের ট্রমা কাটাতে কাউনসেলিংয়ের পাশাপাশি স্কুলে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা দরকার। খেলাধুলা, আঁকা, গল্প লেখা আর গান শোনার মতো সৃজনশীল কাজ শিশুর মনের চাপ কমায়।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউেটর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, ‘এমন পরিস্থিতিতে অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, অনিদ্রা, খিটখিটে মেজাজসহ দেখা দিতে পারে অনেক কিছু। বিশেষ যতœ নিতে হবে সবার। নিতে হবে বিশেষ মানসিক যতœ। বড় কোনো দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মানসিকভাবে ট্রমাটাইজড হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে সময়মতো কাউনসেলিং না পেলে এই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।’
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, এখনই যতœ না নিলে বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। শিশুদের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে, তাদের স্বাভাবিক রাখতে হলে প্রথমেই তাদের অনুভব করাতে হবে। কান্না-ভয় ও দুর্ঘটনাÑ এগুলো স্বাভাবিক জীবনেরই অংশ। শিক্ষার্থীদের আবারও ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন যতœ, সহমর্মিতা আর পরিকল্পনা।
রাজউক ও বিমান কর্তৃপক্ষের দায় নিয়ে প্রশ্ন
দুর্ঘটনার পর রাজউকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে বিমানবন্দরের এত কাছাকাছি এমন একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হলোÑ এ প্রশ্ন উঠেছে দুর্ঘটনার পরপরই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের পরিচালক (জোন ওয়ান) মো. হাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘ওপরের নির্দেশ আছে, এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে চাই না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ গ্রুপ ক্যাপ্টেন নূরে আলম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, মাইলস্টোনের ভবনগুলো উচ্চতা সীমার মধ্যে থাকলেও রাজধানীতে অন্তত ৬৩০টি ভবন নিয়ম ভঙ্গ করেছে। একাধিকবার চিঠি দেওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ সময় তিনি জানান, দুর্ঘটনার দিন দিয়াবাড়ি ক্যাম্পের লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহাসিন দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা চালান। তার দাবি, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কারণেই হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়েনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন