বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জনাব আলী, ব্যুরো

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৫, ০২:১৫ এএম

ঋণের ফাঁদে মানসিক চাপে বাড়ছে আত্মহত্যা

জনাব আলী, ব্যুরো

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৫, ০২:১৫ এএম

ঋণের ফাঁদে মানসিক চাপে বাড়ছে আত্মহত্যা

রাজশাহীর শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় নি¤œবিত্ত পরিবারের মধ্যে এনজিও ঋণজনিত চাপ ক্রমেই উদ্বেগজনক আকার নিচ্ছে। অভাব-অনটন ও কৃষি বা ছোট ব্যবসার অপ্রত্যাশিত ক্ষতির কারণে মানুষ এনজিও ঋণে ঝুঁকছেন, কিন্তু পরিশোধের চাপ অতিরিক্ত মানসিক অশান্তির সৃষ্টি করছে। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অতিরিক্ত সুদের কারণে পড়ে যান বিপত্তিতে। ফলে মানসিক চাপে পড়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছেন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিরা। 

সম্প্রতি রাজশাহী জেলায় কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে শুধু ঋণগ্রস্ততার জন্য। কয়েক দিন আগে ঋণের কারণে স্ত্রী, ছেলে ও শিশুকন্যাকে হত্যার পর রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামের মিনারুল ইসলামের আত্মহত্যার ঘটনা সবাইকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ওই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই কোনো না কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। তারাও ঋণ নিয়ে চাপের কথা বলছেন। এ অবস্থায় ঋণ দেওয়া সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক ডেকেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। তিনি এ বিষয়ে সবার সঙ্গে কথা বলতে চান। এ ঘটনার কিছুদিন আগে ও পরে রাজশাহীতে ঋণের চাপে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ধরনের মৃত্যু নিয়ে অবশ্য সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। গত ১৫ আগস্ট সকালে পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে মিনারুল ইসলাম (৩০), তার স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ছেলে মাহিম (১৩), মেয়ে মিথিলার (৩) লাশ পাওয়া যায়। ঘরে মেলে মিনারুলের লিখে যাওয়া দুই পাতার একটি চিরকুট।

এতে তিনি লিখে যান, ঋণের চাপে ও খাবারের অভাবে তিনি একে একে মনিরা, মাহিম ও ছোট্ট মিথিলাকে হত্যার পর নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই ঘটনার রেশ না কাটতেই গত সোমবার সকালে জেলার মোহনপুর উপজেলার খাড়ইল গ্রামের পানবরজে আকবর শাহ (৫০) নামের পানচাষির লাশ পাওয়া যায়। তিনিও ঋণগ্রস্ত ছিলেন। তার বাড়ি থেকে ১৩টি বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থার পাস বই উদ্ধার করা হয়।

এর আগে গত ১৬ জুলাই পবার নওহাটা কলেজ মোড় এলাকার একটি ছাত্রাবাসে মো. শামসুদ্দিন (৩২) নামের এক সিএনজি অটোরিকশা চালক আত্মহত্যা করেছেন। তার বাড়ি তানোর উপজেলায়। ঋণের বোঝা টানতে না পেরে তিনি এলাকা ছেড়ে নওহাটায় থাকছিলেন। শামসুদ্দিনের স্ত্রী শিলা খাতুনের ভাষ্য, স্বামীর ঋণ পরিশোধে তিনি নিজেও টেক্সটাইল মিলে শ্রমিকের কাজ করছিলেন। এর মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তার স্বামী।

মোহনপুরের বেলনা গ্রামের রিকশাচালক ফজলুর রহমানও (৫৫) জর্জরিত ছিলেন ঋণে। গত ১৪ আগস্ট রাতে এলাকায় তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফজলুরের মুখ থেকে অনবরত লালা পড়ছে, মুখ দিয়ে বিষের গন্ধ বের হচ্ছে। তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে পরদিন তার মুত্যু হয়।

স্বজনদের দাবি, ২০২২ সালে কেশরহাট এলাকার সুদের কারবারি ধুলু মিয়ার (৪৫) কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন ফজলুর। সুদসহ ৪৩ হাজার টাকা শোধ করলেও আরও টাকা দাবি করছিলেন ধুলু। তাদের অভিযোগ, টাকা না দেওয়ায় ধুলু মিয়াসহ কয়েকজন ফজলুরকে ঘাস মারার বিষ খাইয়ে ফেলে রেখে চলে যান। মৃত্যুর আগে ছেলেকে খুনিদের নামও বলে যান ফজলুর। এ ঘটনায় স্ত্রী আনজুয়ারা বিবি হত্যা মামলা করলে পুলিশ ধুলুকে গ্রেপ্তার করে।

এর আগে ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ জেলার দুর্গাপুর উপজেলার শ্যামপুর গ্রাম থেকে রেন্টু পাইক (৫০) নামের এক কৃষকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সেদিন তার ৫ হাজার টাকা কিস্তি দেওয়ার কথা ছিল। তিনি আত্মহত্যা করেন কিস্তির টাকা জোগাড় করতে না পেরে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজশাহী জেলার অধিকাংশ নি¤œআয়ের মানুষের ঘরে ঘরেই এনজিওর ঋণ রয়েছে। অভাবে পড়ে কেউ বাধ্য হয়েছেন ঋণ নিতে, কাউকে আবার জোর করেই রাখা হয়েছে এনজিওতে। কেউ কেউ আবার এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আরেক এনজিওর ঋণ শোধ করেন। কৃষকরা পানচাষ কিংবা আলুচাষের মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভের আশায় এনজিও থেকে ঋণ নেন। কিন্তু এসব ফসলের দাম কম হলেই পড়ে যান বিপদে। এনজিও ঋণ শোধ হয় না। মানসিক চাপে পরিবারে অশান্তির কারণে আত্মহত্যার পথে ঝুঁকে পড়েন।  

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নিজের গ্রাম গোবিন্দপাড়া। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ঋণগ্রস্ত। মানুষ তো গরিব, ঋণ না নিয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু একবার ঋণ নিলে তা শোধ হয় না। ঋণের চাপে স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার পর আত্মহত্যা করা মিনারুলের গ্রামেরও বেশির ভাগ মানুষ ঋণগ্রস্ত। এ গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘গোটা গ্রামে প্রায় ২৫০ বাড়ি আছে। দু-চার বাড়ি হয়তো পাওয়া যাবে তাদের ঋণ নাই। বাকি সবারই কোথাও না কোথাও ঋণ আছে।’

মিনারুলের ঋণ ছিল বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসে। সংস্থার খড়খড়ি শাখার ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘বামনশিকড়ে আমাদের সদস্য আছে প্রায় ৮০ জন। মিনারুলের আর অল্প কিছু টাকা বাকি ছিল। সে জন্য তাকে চাপাচাপি করা হয়নি। কাউকেই আমরা চাপ দিই না।’

মোহনপুরে আত্মহত্যা করা পানচাষি আকবর শাহর বাড়িতে তার স্ত্রীর নামে পাওয়া গেছে ১১টি সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের পাসবই।

তার মৃত্যু প্রসঙ্গে মোহনপুর থানার ওসি আতাউর রহমান বলেন, আকবরের বাড়িতে ১১টা পাসবই পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬-৭টি পাসবইয়ে ঋণ ছিল। সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা কিস্তি লাগত। কিস্তি দিতে না পারার কারণে মানসিক চাপে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে আমাদের ধারণা।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলামের ঋণ আছে। তিনি বলেন, ‘ঋণ আমি নিয়মিতই পরিশোধ করি। কিন্তু একদিন যদি দেরি হয়, এনজিওর লোকেরা এসে বসে থাকে। টাকা না নিয়ে উঠে না তারা। বাড়িতে না থাকলে বারবার আসতেই থাকে। মানসিক চাপে রয়েছেন বলে জানান তিনি।

স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার পর আত্মহত্যা করা মিনারুল ইসলামের চাচি জানেহার বেগম বলেন, ‘মিনারুল কিস্তির চাপে ঠিকমতো বাড়িতেই থাকতে পারত না। কিস্তির লোকেরা বাড়ি আসত, আমরা বুঝিয়ে পাঠাতাম যে, ‘বাবা, এখন তো মিনারুল বাড়িত নাই, পরে আইসো।’ কিন্তু তারা ঘুরে ফিরে আসত। রাত ৮টা বেজে গেলেও বাড়ির পাশেই বসে থাকত।

ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশন (আরআরএফ) নামের একটি এনজিওর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন জহুরুল ইসলাম (৫৫)। বিদেশে গিয়ে ছেলে দুর্ঘটনায় পড়লে তিনি দুটি কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। এনজিওর মাঠকর্মীরা বারবার বাড়িতে গিয়ে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। উপায় না পেয়ে রাজশাহী শহরের বিনোদপুরে সদ্য বিয়ে দেওয়া মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে আত্মগোপন করেন জহুরুল।

কিন্তু গত ২৯ এপ্রিল সেখানে গিয়েও জহুরুলকে খুঁজে বের করেন আরআরএফের কর্মীরা। অপমান করেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতেই। তখন বানেশ্বরে এনজিওর কার্যালয়ে গিয়ে জহুরুল বলেছিলেন, এভাবে চাপ দিলে আত্মহত্যা ছাড়া তার পথ থাকবে না। তাতেও মন গলেনি কর্মকর্তাদের। ফলে সেদিন দুপুরে ঘাস মারা বিষ কিনে নিয়ে গিয়ে এনজিও কার্যালয়েই পান করেন জহুরুল। এরপর সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থাকলেও এখনো তিনি সুস্থ হতে পারেননি। বলেছে মরে গেলেও কিস্তি দিতে হবে। মেয়ের বাড়ি গিয়ে অপমান করেছে। আমি সহ্য করতে পারিনি। মরে যাওয়ার জন্য বাজার থেকে বিষ কিনে এনে অফিসেই খেয়ে ফেলি।’

রাজশাহীতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে অগণিত অনিয়ম। দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে সদস্য বাড়াতে এনজিওগুলোর ঋণের ফাঁদে ফেলার মতো কার্যক্রম, ঋণ আদায়ে বাড়তি চাপ ও অতিরিক্ত সুদ আদায়ের ব্যাপারে আরও কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শাপলা গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, কেশরহাট, মোহনপুরের ম্যানেজার হাসান মতিউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজশাহীর মানুষের আয় খুব বেশি নয়। এরপরও তারা একাধিক এনজিও থেকে লোন করেন। যার কারণে তাদের জন্য লোন বোঝা হয়ে পড়ে। এ কারণে আমরা একমুখী লোন করার প্রতি জোর দিয়ে থাকি।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন বলেন, ‘একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে গেলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা একক কোনো এনজিও দেয় না। ফলে মানুষ একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নেন। সেটা সঠিকভাবে বিনিয়োগ হলে সমস্যা হওয়ার কথা না, কিন্তু যখন ঋণের টাকার অপব্যবহার হয়, তখনই সেটা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা এনজিওগুলোকে পরামর্শ দিয়ে থাকি, যেন তারা ঋণ দেওয়ার যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় এবং টাকাটা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কি না তা দেখে। নিয়মিত পরিদর্শনের সময়ও আমরা এটা দেখে থাকি।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!