স্বাধীনতারও আগে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক পিএলসি) বিনিয়োগ করেছিল সোনালী ব্যাংক পিএলসি (তদানীন্তন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান)। সেই বিনিয়োগের দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে টানা কয়েক দশক ধরে চলমান প্রশাসনিক জটিলতা ও আইনি মতবিরোধ এখনো অবসান হয়নি। বিষয়টি এখনো মীমাংসিত না হওয়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ওপর আর্থিক চাপ ও নিরীক্ষা-আপত্তি বাড়ছে বলে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক পিএলসি পূবালী ব্যাংকে তাদের স্বাধীনতা-পূর্ব বিনিয়োগসংক্রান্ত দাবি নিষ্পত্তির জন্য আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিষয়টি পুনরায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে।
দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এই বিনিয়োগ দাবি একটি নজিরবিহীন দীর্ঘ প্রশাসনিক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৬৬ বছর পরও স্বাধীনতা-পূর্ব বিনিয়োগের এই আর্থিক দায়-দাবি আজও অমীমাংসিত। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই ধরনের স্থায়ী জট শুধু আর্থিক নয়, বরং নীতিগত প্রশ্নও তুলে দিচ্ছেÑ রাষ্ট্রীয় সম্পদের দায়ভার কতদিন এমনভাবে অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে থাকবে?
স্বাধীনতা-পূর্ব বিনিয়োগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৫৯ সালে তদানীন্তন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠার সময় সরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক মূলধন বিনিয়োগ করে। সোনালী ব্যাংক (তখন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) তখন ওই ব্যাংকের ৩৮,৩৩৫টি শেয়ারে বিনিয়োগ করে, যা পরবর্তীতে ১৯৬৮, ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালের ১০:১ বোনাসের মাধ্যমে ৫১,০২২টি শেয়ারে উন্নীত হয়। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ১০ টাকা হিসেবে সোনালী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৫ লাখ ১০ হাজার ২২০ টাকা।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ১৯৭৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের একটি অনুলিপি সোনালী ব্যাংকে পাঠায়। তাতে বলা হয়, উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে পূবালী ব্যাংক বাধ্য যে, সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে সমপরিমাণ নতুন শেয়ার সনদ ইস্যু করবে। এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে পূবালী ব্যাংককে চিঠি পাঠিয়ে তাদের প্রাপ্য শেয়ার সনদ ইস্যুর অনুরোধ জানায়।
পরবর্তীতে, ১৯৭৭ সালের ২৫ মে পূবালী ব্যাংক কর্তৃক ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ইস্যুকৃত ৫১,০২২টি শেয়ারের ডুপ্লিকেট সনদ ইস্যু করে সোনালী ব্যাংকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে পূবালী ব্যাংক বেসরকারিকরণ হয়ে ‘পূবালী ব্যাংক লিমিটেড’ নামে নতুনভাবে গঠিত হলে, সোনালী ব্যাংক ১৯৮৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাদের ধারণকৃত শেয়ারগুলোর আইনি অবস্থান জানতে চেয়ে পত্র পাঠায়। জবাবে পূবালী ব্যাংক জানায়, জাতীয়করণের সময় ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের দায়ভার ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৬-এর অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী সরকারের ওপর বর্তায়। সেই দায়ভার কোনো সংশোধনের মাধ্যমে পূবালী ব্যাংকের ওপর আরোপিত হয়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংক তাদের প্যানেল আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরারুল হোসেনের কাছে আইনি মতামত চায়। তিনি ১৯৮৪ সালের ২২ নভেম্বর মত দেন, পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের এই অবস্থান আইনসঙ্গত নয়। তার মতে, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকগুলো জাতীয়করণ আদেশ অনুযায়ী দাবিকৃত শেয়ার পূবালী ব্যাংকেরই বিধিবদ্ধ দায়, যা কোনো সরকারি চুক্তির মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব নয়। তিনি সুপারিশ করেন, পূবালী ব্যাংক যেন শেয়ার সমন্বয় করে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে নতুন শেয়ার ইস্যু করে।
১৯৯৮ সালের সভা ও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত
অমীমাংসিত দাবিটি নিয়ে ১৯৯৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব আমিনুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি স্পষ্টভাবে মত দেন, এ জাতীয় দাবি কখনো বিলুপ্ত হয় না, দায় থেকেই যায়।
সভাপতি মন্তব্য করেন, যদি পূবালী ব্যাংক কর্তৃক এ দাবি পরিশোধ সম্ভব না হয়, তাহলে দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে। বৈঠকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়Ñ এ ধরনের দাবি মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও প্রীতি কুমার চাকমার দাবির বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হবে। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংককে দ্রুত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে হবে। দাবির বিষয়ে দ্রুত অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে।
২০১৬ সালের পর থেকে নতুন উদ্যোগ
দীর্ঘ স্থবিরতার পর ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুল হকের সভাপতিত্বে আবারও একটি সভা হয়। সেখানে সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধিরা স্বাধীনতা-পূর্ব বিনিয়োগের আসল ও লভ্যাংশসহ সব পাওনা পরিশোধের দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়Ñ সোনালী ব্যাংক দাবির পক্ষে দলিল ও প্রমাণাদিসহ লিখিত বক্তব্য দেবে। পূবালী ব্যাংক বিক্রেতা চুক্তি ও প্রাসঙ্গিক নথি জমা দেবে। উভয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পরবর্তী আট বছরে ৯ দফা পত্র
ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সোনালী ব্যাংক ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রথম লিখিত বক্তব্য দাখিল করে। পরবর্তীতে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ব্যাংকটি ৯ দফায় (২৬ জুলাই ২০১৭, ৩ জানুয়ারি ২০১৮, ১০ জুলাই ২০১৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২ ডিসেম্বর ২০২০, ৪ এপ্রিল ২০২২ ও ১৪ নভেম্বর ২০২৩) অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। কিন্তু এসব চিঠির কোনো কার্যকর জবাব বা পদক্ষেপ সম্পর্কে ব্যাংকটি এখনো অবহিত হয়নি। এমনকি পূবালী ব্যাংককেও ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর (পত্র নম্বর ১৭২৭) চিঠি দেওয়া হলেও তাদের পক্ষ থেকেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
দীর্ঘসূত্রতায় আর্থিক প্রভাব
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শওকত আলী খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই বিনিয়োগের দাবিটি নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকের মূলধনী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিনিয়োগকাল থেকে প্রতিবছরই তহবিল ব্যয় ও সুযোগ ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, পাশাপাশি নিরীক্ষা ও পরিদর্শনকালে বারবার আপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।
অন্যদিকে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, সোনালী ব্যাংকের উত্থাপিত এই দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নেই।
ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতা-পূর্ব বিনিয়োগ নিয়ে দুই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এই দীর্ঘ আইনি ও প্রশাসনিক জট শুধু আর্থিক দায় নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের দুর্বলতারও প্রতিফলন। সরকারি ব্যাংকগুলোর তহবিল বিনিয়োগের হিসাব নিরসনে স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে প্রকট করেছে।
একজন সাবেক অর্থ সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই ধরনের ঐতিহাসিক বিনিয়োগসংক্রান্ত দাবিগুলোর আইনি কাঠামো দুর্বল এবং কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় এগুলো বছরের পর বছর অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে। এটি রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় শিক্ষা।
পুনর্বিবেচনার দাবি
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান তার সর্বশেষ চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, স্বাধীনতা-পূর্ব ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই বিনিয়োগের স্বীকৃতি ও দাবি নিষ্পত্তি উভয় ব্যাংকের জন্যই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন, ইতোপূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হোক।