ঢাকা বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫

শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন হত্যা : কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেয় রনি ও ফারুক

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৫, ০১:১৬ এএম
রনি ও ফারুক

পুরান ঢাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে (৫৫) প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার মিশনে একাধিক ব্যাকআপ টিম কাজ করেছে বলে ধারণা পুলিশের। মামুনের ঘনিষ্ট সূত্র থেকে কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেওয়া দুইজন ছাড়াও আরেকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ভাগ্নে রনি আগে সরকারের একটি বাহিনীতে চাকরি করত বলে দাবি ওই সূত্রের। মামুনের পরিবারের দাবি, ভালো হতে চাওয়ার কারণেই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন মামুন।

এদিকে মামুন হত্যায় অংশ নেওয়া দুই শুটারকে শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।  গ্রেপ্তার দুজন হলেন শুটার রুবেল ও ইব্রাহিম। তারা দুজনই পেশাদার শুটার হিসেবে কাজ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশের একটি দল তাদের গ্রেপ্তার করে।  তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন।

২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তেজগাঁওয়ে মামুনের ওপর আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন গ্রুপের হামলার সময় গুলিতে মারা যান নিরীহ ভুবন চন্দ্র শীল। এখনো বিচার না পেয়ে গভীর হতাশ ভুবনের সহধর্মিণী। তবে গত সোমবার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে আর শেষ রক্ষা হয়নি মামুনের। খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সিসি ফুটেজে ধরা পড়ে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা। নিহত মামুন একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সহযোগী ও বন্ধু ছিলেন।

জানা গেছে, হত্যাকারীদের পরিচয় পুলিশ শনাক্ত করতে না পারলেও, মামুনের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, মাথায় ক্যাপ পরে মুখে মাক্স লাগানো যে ব্যক্তিকে গুলি করতে দেখা যাচ্ছে তার নাম ‘ভাগ্নে’ রনি।  এই রনি সরকারি বাহিনীর চাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে। আর, চেক শার্ট পরা যাকে গুলি করতে দেখা যাচ্ছে তাকে সবাই ‘কুত্তা ফারুক’ হিসেবে চেনে। উত্তরা এলাকায় বসবাস তাদের। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া আরেকজনকেও দেখা যায় সিসি ক্যামেরায়। গুলি ছোড়া দুজন ব্যক্তির ঠিক পেছনেই ছিলেন তিনি, আন্ডারওয়ার্ল্ডে তাকে সবাই ‘শুটার’ কামাল হিসেবেই চেনে।

পুলিশ বলছে, ওই এলাকার আরও সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ চলছে। পরিবার বলছে, প্রতিদিন সঙ্গে লোক থাকলেও সোমবার একাই আদালতে হাজিরা দিতে যায় মামুন। এ ঘটনায় মামুনের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইমন সরাসরি জড়িত বলেও দাবি তাদের। এদিকে ইমনসহ খুনিদের ধরতে অভিযান চলছে বলে জানা গেছে।

গত বছরের পাঁচ আগস্টের পর ধানমন্ডি এলাকায় সন্ত্রাসের একক রাজত্ব চালাচ্ছে সানজিদুল ইসলাম ইমন। তার বাহিনীর হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে যাওয়া এক ব্যবসায়ী ইমনকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছিলেন থানায়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধ কর্মকা- নিয়ে পুলিশের গা-ছাড়াভাবের কারণে প্রকাশ্যে মামুন হত্যার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।

প্রায় ২৯ বছর আগে মোহাম্মদপুর এলাকায় হিমেল নামের ২৫ বছরের এক যুবককে গুলি করে হত্যা মামলায় হাজিরা দিতে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২-এ গিয়েছিলেন তারিক সাইফ মামুন (৫৫)।  ওই মামলায় আসামি হিসেবে আছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, হেলালসহ আরও ৬ জনের নাম।  কোনো সাক্ষী না আসায় পূর্ব নির্ধারিত দিন হিসেবে গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাজিরা দেন মামুন। বিচারক আগামী বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করলে বেলা পৌনে ১১টার দিকে আদালত ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মামুন। আদালত থেকে বের হওয়ার পর একটি গাড়িতে ওঠেন মামুন। রাস্তায় জ্যাম থাকায় আবার নেমে পড়েন। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে পিস্তল নিয়ে মামুনকে ধাওয়া করে দুই ব্যক্তি। জীবন বাঁচাতে মামুন দৌড়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশের চেষ্টা করেন।  হাসপাতালের গেটের কাছে যেতেই ডান পায়ের স্যান্ডেল খুলে পড়ে যান তিনি।  এর মধ্যেই তাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি ছোড়ে।  হাতে, বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই পড়ে যান মামুন। ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে ন্যাশনাল মেডিকেলে নিলেও তাকে সেখানে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।  দীর্ঘদিন পর ঢাকার দিনেদুপুরে সংঘটিত এই হত্যাকা-ের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে আতঙ্কবোধ করেন অনেকে। অনেকেই বলছেন, গুলি করে মামুনকে হত্যার নেপথ্যে কী? সেটা সামনে আসা উচিত।

এই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামি বলেন, ‘নিহত মামুন একজন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলাসহ তার নামে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ময়নাতদন্ত হয়েছে, রিপোর্ট পেলেই অনেক তথ্য উঠে আসবে।  সেগুলো তদন্তের স্বার্থে কাজে লাগবে।  তা ছাড়া হত্যার নেপথ্যে ঘটনা কী? সেটাও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।’

মামুন হত্যা : আদালত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি: এদিকে ঢাকার আদালত পাড়ার অদূরে দিনেদুপুরে এক আসামি হত্যাকা-ের পর আদালত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান এ চিঠি পাঠান বলে জানিয়েছেন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নাজির আবুল হাসান কানন।

২৮ বছর আগের এক মামলায় হাজিরা দিতে গত সোমবার ঢাকার আদালতে আসেন এক সময়ের ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফ মামুন। ফেরার পথে আদালতের কাছে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ফটকের সামনে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। মামুনকে প্রকাশ্যে মেরে ফেলার কথা উল্লেখ করে পুলিশকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘তিনি আদালতে একজন বিচারপ্রার্থী হিসেবে সংশ্লিষ্ট একটি আদালতে হাজিরা প্রদান করে বাড়ি ফেরার সময় কোর্ট আঙিনার পাশে তাকে হত্যা করা হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আদালত প্রাঙ্গণ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই নাজুক।’

বিচারক মোস্তাফিজুর রহমান চিঠিতে বলেছেন, ঢাকার আদালতপাড়ায় মহানগর হাকিমের ৩৭টি আদালত বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। ঢাকা মহানগরীর ৫০টি থানার বিভিন্ন ধরনের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, সেসব বিচারকের রোজকার কার্যক্রম সম্পাদনে নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।