- সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধনে রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকা গচ্ছা
- অনুসন্ধানের তালিকায় তিন ছেলের নাম
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে টানা ১০ বছর রাষ্ট্রপতি থাকা আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে নিজ ভবনসংলগ্ন এলাকায় সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ উঠেছে। শুধু অভিযোগ নয়, যাচাই-বাছাই শেষে তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তও নিয়েছে সংস্থাটি। সাবেক রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে আবদুল হামিদ হচ্ছেন দ্বিতীয়, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মুখোমুখি হচ্ছেন। এর আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম দুদকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যাতে তিনি সাজাও ভোগ করেছিলেন।
গতকাল রোববার দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অনুসন্ধানে আবদুল হামিদের তিন ছেলে সাবেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক, রাসেল আহমেদ তুহিন ও রিয়াদ আহমেদ তুষারও রয়েছেন। গত ১৮ নভেম্বর এ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি দল গঠন করা হয়েছে। দলে আরও রয়েছেন সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ও উপসহকারী পরিচালক রোমান উদ্দিন।
জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকা নিকুঞ্জের লেকড্রাইভ রোডের ৬ নম্বর প্লটে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের তিনতলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, যেখানে তিনি রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষে উঠেছিলেন। যদিও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সেই বাসা ছেড়ে দেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, আবদুল হামিদ তার ওই আবাসিক ভবনের দুপাশের রাস্তা হাঁটার (ওয়াকওয়ে) জন্য বাঁধিয়েছেন। নান্দনিক ডিজাইনে তৈরি ডেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে শুরু করে খালসংলগ্ন রাস্তায় অত্যাধুনিক ল্যাম্পপোস্ট সবই তৈরি করা হয়েছিল তার সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে। প্রকল্পের অংশ না হলেও পূর্বাচল নতুন শহর ঘিরে একশ ফুট চওড়া খাল খনন প্রকল্পের আওতায় খালটি সংস্কার করা হয়। রাজউকের তত্ত্বাবধানে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, যেখানে রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়।
জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ১০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিলে আবদুল হামিদ সপরিবারে নিকুঞ্জের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর এলাকাটি রীতিমতো নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া সাধারণের প্রবেশে ব্যাপকভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তবে পট পরিবর্তনের পর আলোচিত বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে।
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আবদুল হামিদ ও অন্যান্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ব্যক্তিগত সুখবিলাসের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকায় সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাবদ রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকা ক্ষতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিকুঞ্জের লেকড্রাইভ রোডের ৬ নম্বর প্লটে আবদুল হামিদের ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে। সেই বাড়ি ঘিরে সাজসজ্জায় অর্থ ব্যয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিল দুদক। দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা আবদুল হামিদের সঙ্গে তার তিন ছেলের নামও রয়েছে অনুসন্ধানের তালিকায়।
দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে অভিযোগটি অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ মার্চ একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘হামিদের সুখবিলাসে গচ্ছা ২৪ কোটি টাকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, লেকড্রাইভ রোডের ৬ নম্বর প্লটে হামিদের তিনতলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। কর্নার প্লট হওয়ায় বাড়ির দুই দিকে ফাঁকা। সামনের অংশে প্রবহমান খাল। দুপাশে হাঁটার (ওয়াকওয়ে) বাঁধানো রাস্তা। নান্দনিক ডিজাইনে তৈরি ডেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ। দেশি-বিদেশি ফুল ও শৌখিন পাতাবাহারে সজ্জিত চারপাশ। এমনকি খালের পানিতেও ভাসছে পদ্ম ফুল। সারি সারি খেজুরগাছ লেকের পাড় ঘেঁষে। গাছের খাঁজে খাঁজে নিয়মিত রস সংগ্রহের চিহ্ন। খালসংলগ্ন রাস্তা আলোকিত করতেও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। কিছুদূর পরপর বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাম্পপোস্ট।
রাজউকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এমপি কোটায় নিকুঞ্জ-১ (দক্ষিণ) আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দের আবেদন করেন আবদুল হামিদ। সে অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর তাকে তিন কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ২০১১ সালে সেখানে বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনি নকশা অনুমোদন নেন। মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকায় প্লট রেজিস্ট্রি করেন আবদুল হামিদ।
রাজউক ও দুদক সূত্রে জানা যায়, নিকুঞ্জ-১ এলাকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছাড়াও আওয়ামী দোসর হিসেবে পরিচিত আরও অনেকের বাড়ি রয়েছে। হাসিনা সরকারের একাধিক এমপি-মন্ত্রীসহ দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা এবং হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীদের অনেকে ওই এলাকায় চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তাদের মধ্যে হামিদের বাড়ির পাশেই ৭ নম্বর প্লটে বাড়ি করেছেন পলাতক সাবেক হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। ৪ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাড়ির মালিক হাসিনার আত্মীয় মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত।
এ ছাড়া শেখ হাসিনার সাবেক প্রেস সেক্রেটারি নাঈমুল ইসলাম খান, সাংবাদিক নেতা ও হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিবি হারুনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার হোসেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর ব্যাপারী, শেখ পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য এবং দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমা খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী কবির হোসেন ওরফে শেখ কবির এবং সুইডেন আওয়ামী লীগের নেতা বিতর্কিত ব্যবসায়ী কাজী শাহ আলম ওরফে ফুল শাহ আলম নিকুঞ্জ এলাকায় বাড়ি করেছেন।

