ঢাকা রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত

দুর্যোগে মানসিক স্বাস্থ্য দ্রুত সেবা ও সচেতনতার  ওপর বিশেষ জোর

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৫, ১১:৫১ পিএম

সারা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার সারা বিশে^র মতো বাংলাদেশেও পালন করা হয়েছে দিবসটি। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুর্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব এবং দ্রুত সেবা ও সচেতনতার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

২০১৮-১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ডিপ্রেশন (বিষণœতা) ও অ্যাংজাইটি (উদ্বেগ)। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, কিন্তু চিকিৎসা নিচ্ছে খুবই কমসংখ্যক মানুষ। জরিপে দেখা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৯৪ শতাংশ শিশু কখনোই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসেনি। তারা না খায় ওষুধ, না কাউনসেলিং করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম পারিশ্রমিক, কর্মী ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়ে মূলত কর্মীরা বিষণœতায় ভোগেন। কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ কাজ হারান।

এদিন একটি অনলাইন গণমাধ্যম আয়োজিত ‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. নিলুফার আখতার জাহান বলেন, দুর্যোগের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে দুশ্চিন্তা, হতাশা, রাগ, ঘুমের সমস্যা, কাজের প্রতি আগ্রহের অভাব। তবে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মানসিক সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, বিশেষ করে যারা আগেই মানসিক রোগে ভুগছেন।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দুর্যোগের পর প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে ১৩ শতাংশ মৃদু রোগ যেমনÑ ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার ও অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং ৯ শতাংশ গুরুতর রোগ যেমনÑ সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হন। ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে রোগীরা দীর্ঘ সময় বিষণœতায় ভোগেন এবং কখনো কখনো আত্মহত্যার চিন্তা করেন। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া আফরিন বলেন, শিশু-কিশোরেরা কোনোভাবেই প্রাপ্তবয়স্কদের ছোট সংস্করণ নয়। তাদের মানসিক বিকাশের প্রতিটি ধাপে আলাদা চাহিদা থাকে। হঠাৎ স্কুলে না যেতে চাওয়া, বন্ধুদের এড়িয়ে চলা, ঘুম বা খাওয়ায় অরুচি এই লক্ষণগুলো মানসিক চাপের ইঙ্গিত দেয়। তিনি আরও যোগ করেন, মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত, কিন্তু ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৯৪ শতাংশ শিশু-কিশোর কখনো চিকিৎসাসেবা পায়নি।

বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় মানসিক সমস্যার সমাধানের ওপর। এর মধ্যে ১. প্রাথমিক সেবা: মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা, ২. কাউনসেলিং ও থেরাপি: ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা ইন্টারনেট আসক্তির জন্য বিহেভিয়ার থেরাপি ও কাউনসেলিং কার্যকর, ৩. সাইকিয়াট্রিক নার্স: সিনিয়র স্টাফ নার্স শফিউল আজম বলেন, নার্সরা রোগীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটান। তাই তাদের প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা বাড়ানো মানসিক সেবার জন্য অপরিহার্য, ৪. পরিবার ও কমিউনিটির ভূমিকা: শিশু-কিশোরদের জন্য রুটিন তৈরি, প্রযুক্তি ব্যবহারে নজরদারি এবং আউটডোর বা সৃজনশীল কার্যক্রমে উৎসাহিত করা।

এ সময় ডা. নিলুফার জাহান সতর্ক করে বলেন, যদি মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সমস্যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। দুর্যোগের সময় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজনীয় এবং তা দ্রুত কার্যকর করা জরুরি। গোলটেবিলে আরও আলোচনা হয় আইনি জটিলতা, আত্মহত্যা সম্পর্কিত সচেতনতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা সবশেষে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত সেবার ব্যবস্থা নিশ্চিতের আহ্বান জানান।

একই দিন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের শহিদ ডা. মিলন হলে মনোরোগবিদ্যা বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গেলে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অজ্ঞতা। বিশ^বিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে তিনি আরও বলেন, সাধারণ জনগণ অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে চান না। কারণ তারা মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব এবং সেবার ধরন সম্পর্কে জানেন না। অথচ যদি যথাযথভাবে বোঝানো যায়, তাহলে তারা আগ্রহী হন। তিনি বলেন, শিক্ষিত মানুষের মাঝেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। এমনকি অনেক চিকিৎসক পরিবারেরও সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তবু সেবা নিচ্ছেন না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। জনগণ এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিদ্যালয়গুলোতেও ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালুর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. এম এম এ সালাউদ্দিন কাউসার। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেনÑ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের মহাসচিব প্রফেসর ডা. নিজাম উদ্দিন ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের পরিচালক প্রফেসর ডা. মাহবুবুর রহমান।