বর্তমান বাংলাদেশ যেন এক বিভীষিকাময় অধ্যায় অতিক্রম করছে। সহিংসতা, খুনোখুনি, সন্ত্রাসী ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনা আমাদের প্রতিনিয়ত শঙ্কিত করছে। তাই আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির এই সময়ে মানুষের মনে সহজেই প্রশ্ন আসছেÑ রাষ্ট্র কোথায়? সরকার কী করছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কতটা কার্যকর? সম্প্রতি পুরান ঢাকায় ঘটে যাওয়া ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের নৃশংস হত্যাকা- আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। মিটফোর্ড হাসপাতালের মতো জনবহুল এলাকায় শত শত মানুষের সামনে পিটিয়ে ও কুপিয়ে একজনকে হত্যা করা হয়। এমনকি তার নিথর দেহ টেনে রাস্তায় এনে পাথর দিয়ে মাথা-বুক থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ ঘিরে প্রকাশ্যে করা হয়েছে উল্লাস। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এসব ঘটনার সময় আশপাশের কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি, বরং কেউ কেউ ভিডিও করেছে। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, সমাজের মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়েরও প্রতিচ্ছবি বলা যায়। এ ছাড়া একই সময়ে চাঁদপুরে একজন খতিবকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করার ঘটনা, কিংবা খুলনার দৌলতপুরে একজন সাবেক যুবদল নেতাকে রগ কেটে হত্যাÑ সব মিলিয়ে কিছু প্রশ্ন মাথায় আসে, দেশে কি আদৌ কোনো নিরাপদ স্থান আছে? যেখানে মসজিদের মতো পবিত্র স্থানেও কেউ নিরাপদ নয়, সেখানে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা কোথায়? মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা কিংবা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অনেক ঘটনায় প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা হলেও বিচার বা শাস্তির নজির খুব কমই দেখা যায়। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আমাদের সমাজে অপরাধপ্রবণতাকে আরও উসকে দিচ্ছে। কারণ অপরাধীরা এরই মধ্যে জেনে গেছেÑ যে কোনো অপরাধেই পার পাওয়া সম্ভব। এই অবস্থায় আরও প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্র কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে? কেন প্রতিটি ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে শুধু হুঁশিয়ারি বার্তা দেওয়া হয়, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা না যাওয়ার কারণ কী? থানা-পুলিশ কোথায়? প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোথায়? কোন নৃশংস ঘটনার পর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ায় না? এটাই কি আমাদের রাষ্ট্র চালনার নতুন বাস্তবতা? এমন চলতে থাকলে সামাজিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়বে। মানুষ আত্মরক্ষায় নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তখন বিচার হবে রাস্তায়, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় বা ব্যক্তিগত আক্রোশে। সুশৃঙ্খল সমাজ পরিণত হবে বিশৃঙ্খল অরাজকতায়। আইনহীনতার সেই ভয়াবহতা থেকে কোনো দল, কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণি নিরাপদ থাকবে না। তাই এখনই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার। পুলিশের সংস্কার, তদন্তের পদ্ধতিগত উন্নয়ন, দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিÑ এ সবই হতে হবে একসঙ্গে এবং এখনই। রাজনীতি ও প্রশাসনের অভ্যন্তরে যে দুর্বলতা, অনৈতিকতা ও দায় এড়ানোর প্রবণতা আছে, তা দূর না করলে কেবল ঘটনাগুলো সংবাদ শিরোণাম হয়েই রয়ে যাবে। তাই সরকারকে বুঝতে হবেÑ উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোর নয়, নিরাপত্তা, মানবিকতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করেই তা টেকসই হয়। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়। এই দায় পালনে অবহেলা শুধু জনগণের আস্থা হারাবে না, ধ্বংস করে দেবে রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিও। তাই রাষ্ট্রীয় ভিত্তি ও রাষ্ট্রের মানুষের বিশ্বাস ধরে রাখতে এখনই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
আপনার মতামত লিখুন :