জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের আর্থিক ভিত্তি মজবুত রাখার অন্যতম প্রধান নিয়ামক। সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় নির্বাহসহ সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের মূল উৎসই কর রাজস্ব।
চলতি বছরের ১২ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশে এনবিআরকে বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়। দুই বিভাগের কার্যপরিধি কী হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতিবিদরা সিদ্ধান্তটিকে সময়োপযোগী মনে করলেও এর প্রতিবাদে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘কলম বিরতি’ পালন করে। দেশের বিভিন্ন গণম্যাধমের সংবাদে জানা গেছে, আন্দোলনের কারণে মে মাসের প্রথম ২০ দিনে মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে এনবিআর রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে আছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কর্মবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচি পালনে দুই দিনে দেশের অর্থনীতিতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আইআরডির যুগ্ম সচিব সৈয়দ রবিউল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, আইআরডি, ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর প্রতিনিধিও রাখা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায়ে এনবিআরকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও কার্যকর কৌশল নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে করজাল তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ। দেশের বড় অংশ এখনো কর ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে। ভ্যাট ও আয়কর খাতে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত রাজস্ব আহরণ সম্ভব হচ্ছে না মূলত দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে।
এনবিআরকে ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করতে হবে। করদাতার হয়রানি বন্ধে অনলাইন রিটার্ন দাখিল ব্যবস্থা সহজ ও সেবামুখী করা জরুরি। এ ছাড়া বড় কর ফাঁকি দাতাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসা ও বাণিজ্যবান্ধব নীতির পাশাপাশি কর ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। কর দাতার আস্থা অর্জন করতে না পারলে রাজস্ব আহরণে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য আসবে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কর আদায়ে বৈষম্যমূলক আচরণ যেন না হয়। ধনীদের ছাড় দিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিলে সেটা হবে সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থি। সঠিক তথ্যভিত্তিক করনীতি এবং সুশাসন ছাড়া রাজস্ব লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
সার্বিক বিবেচনায়, এনবিআরের রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম শুধু সরকারকে অর্থ জোগানের বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার প্রশ্ন। তাই এ খাতে দুর্নীতি রোধ, দক্ষ জনবল নিয়োগ, কর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার অব্যাহত রেখে এনবিআরের রাজস্ব আদায় তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমেই এই লক্ষ্যে সফলতা অর্জন সম্ভব।
আমরা আশা করব, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘কলম বিরতি’ পালন করার কারণে রাষ্ট্র যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা নিরূপণের কমিটি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করবে। সেই সঙ্গে সরকার যেকোনো মূল্যে রাজস্ব আদায়ের ধারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে তা অব্যাহত রাখবে।