আজকের এই দ্রুতগতির ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি পণ্য আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। হাতে থাকা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে অফিসের ল্যাপটপ, ঘরের স্মার্ট টেলিভিশন থেকে গাড়ির নেভিগেশন সিস্টেম, সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর। এই সুবিশাল বাজারের একটি বড় দুর্বলতা হলো দামের অস্বচ্ছতা। একই মডেলের একটি মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের দাম বিভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বরং যেন একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতারা প্রায়শই সঠিক দাম নিয়ে বিভ্রান্ত হন, আর অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে ক্রেতার পকেট কাটেন। এই সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান হলো পণ্যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বা এমআরপি (গধীরসঁস জবঃধরষ চৎরপব) নির্ধারণ করা। কিন্তু আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা এখনো কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তা একটি বড় প্রশ্ন।
এমআরপি কী এবং কেন এটি আবশ্যক?
এমআরপি হলো কোনো পণ্য একজন ক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ যে দামে বিক্রি করা যেতে পারে, সেই দাম। পণ্য উৎপাদনকারী বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্যের মোড়কে এই দাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো খুচরা বিক্রেতাদের অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন থেকে বিরত রাখা এবং ক্রেতাকে প্রতারণা থেকে রক্ষা করা।
এমআরপি বাধ্যতামূলক করা হলে তা কেবল ক্রেতার জন্য নয়, বরং সামগ্রিক বাজারের জন্যও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ক্রেতা সুরক্ষা। যখন কোনো পণ্যের গায়ে এমআরপি লেখা থাকে, তখন ক্রেতা নিশ্চিত হন যে তিনি সঠিক দামে পণ্যটি কিনছেন। এতে দাম নিয়ে দরকষাকষি বা প্রতারণার সুযোগ থাকে না। দ্বিতীয়ত, এটি বাজারে স্বচ্ছতা ও সমতা আনে। যখন সব দোকানে একটি পণ্যের দামের একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে, তখন ক্রেতারা সহজেই দামের তুলনা করতে পারেন এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারেন। তৃতীয়ত, এমআরপি অতিরিক্ত মুনাফা রোধ করে। বিশেষ করে যখন কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, তখন অসাধু বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বা ক্রেতার অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত দাম আদায় করে। এমআরপি এই প্রবণতাকে কার্যকরভাবে বন্ধ করতে পারে। পরিশেষে, এমআরপি ব্যবস্থা কার্যকর হলে পণ্যের বিক্রয় মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সরকারও সঠিক রাজস্ব এবং ভ্যাট আদায় করতে পারে।
বিশ্বে এমআরপি বা অনুরূপ আইনের প্রয়োগ: ভারত থেকে ইউরোপ
এমআরপি বা এর মতো আইন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে কার্যকর আছে। এর সবচেয়ে বড় এবং সফল উদাহরণ হলো ভারত। ভারতে ঈড়হংঁসবৎ চৎড়ঃবপঃরড়হ অপঃ-এর অধীনে প্রযুক্তি পণ্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যে এমআরপি উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। এমআরপি-এর বেশি দামে কোনো পণ্য বিক্রি করলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। এর ফলে ভারতের প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে একটি নির্দিষ্ট স্বচ্ছতা দেখা যায়।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত উৎপাদক বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্যের মোড়কে জবপড়সসবহফবফ জবঃধরষ চৎরপব (জজচ) বা ঝঁমমবংঃবফ জবঃধরষ চৎরপব (ঝজচ) উল্লেখ করে। যদিও এটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়, তবুও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং উচ্চ ক্রেতা সচেতনতার কারণে বিক্রেতারা সাধারণত এই দামে আশপাশেই পণ্য বিক্রি করে।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, একটি সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার জন্য এমআরপি একটি অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ। যখন ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের বাজারে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে, তখন বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এটি করা কেন সম্ভব নয়?
এমআরপি না থাকায় ক্রেতা সাধারণের ক্ষতি:
এমআরপি না থাকার সবচেয়ে বড় শিকার হন ক্রেতা সাধারণ। তারা একই পণ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন দামে কিনে প্রায়শই প্রতারণার শিকার হন। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার প্রযুক্তি পণ্যের বড় বাজারগুলোতে একই মডেলের একটি ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের দাম ২০০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত পার্থক্য দেখা যায়। একজন ক্রেতা কোনো নির্দিষ্ট দোকান থেকে পণ্য কেনার পর অন্য দোকানে গিয়ে দেখেন যে তার কেনা পণ্যটির দাম আরও কম। এতে ক্রেতা হতাশ হন এবং বাজারে আস্থা হারান। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় ক্রেতার সময় ও অর্থের, যা তিনি ন্যায্যমূল্যের সন্ধানে নষ্ট করেন।
এমআরপি থাকলে ক্রেতা ও সরকারের লাভ এবং রাজস্ব আয়ের ওপর প্রভাব:
যদি এমআরপি চালু হয়, তাহলে ক্রেতা সাধারণের সবচেয়ে বড় লাভ হলো তারা নিশ্চিতভাবে সঠিক দামে পণ্যটি কিনতে পারবেন। এর ফলে দাম নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি বা প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। বাজারের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হবে।
অন্যদিকে, এমআরপি থাকলে সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। বর্তমানে অনেক পণ্য অনানুষ্ঠানিক পথে বা ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে কম মূল্য দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়। এমআরপি বাধ্যতামূলক হলে, প্রতিটি পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারিত থাকবে, যার উপর ভিত্তি করে সরকার সঠিক ভ্যাট এবং ট্যাক্স আদায় করতে পারবে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
প্রযুক্তি সমিতির মন্তব্য ও আইনগত দিক:
বাংলাদেশের প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে নেতৃত্ব দেওয়া বিভিন্ন সমিতির মধ্যে এমআরপি নিয়ে ভিন্নমত দেখা যায়। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) বা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর মতো সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলে আসছে। তাদের মতে, এমআরপি চালু হলে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং অন্যায় প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে।
তবে, প্রযুক্তি পণ্যের ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে অনেকে এর বিরোধিতা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিলার বলেন, ‘এমআরপি ব্যবস্থা চালু হলে আমাদের লাভের মার্জিন অনেক কমে যাবে। তখন নতুন করে এই ব্যবসায় আসা কঠিন হবে।’
বর্তমানে বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর আওতায় কোনো পণ্যের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু এই আইনে প্রযুক্তি পণ্যের জন্য এমআরপি বাধ্যতামূলক করার সুস্পষ্ট বিধান নেই। তাই নতুন করে একটি আইন প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। অথবা বিদ্যমান আইনকে সংশোধন করে প্রযুক্তি পণ্যের ক্ষেত্রে এমআরপি বাধ্যতামূলক করা উচিত।
সমাধান ও ভবিষ্যৎ
প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে স্বচ্ছতা আনা এবং ক্রেতা সুরক্ষার জন্য এমআরপি ব্যবস্থা চালু করা অপরিহার্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যদি এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের পক্ষেও তা সম্ভব। এর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
* আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগ: সরকারকে অবিলম্বে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনকে আরও শক্তিশালী করে প্রযুক্তি পণ্যে এমআরপি বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিতে হবে। আইনটি এমন হতে হবে, যেখানে এমআরপি না থাকলে বা বেশি দামে বিক্রি করলে বড় অঙ্কের জরিমানা ও কারাদ-ের বিধান থাকবে।
* সচেতনতা বৃদ্ধি: সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ক্রেতা সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ‘এমআরপি দেখে পণ্য কিনুন’- এই ধরনের প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
* মনিটরিং ব্যবস্থা: সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর (যেমন- জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর) মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে, যাতে কোনো বিক্রেতা আইন লঙ্ঘন করতে না পারে।
* ডিলার ও বিক্রেতাদের জবাবদিহিতা: আমদানিকারক ও ডিলারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের কাছ থেকে পণ্যের খুচরা মূল্য সম্পর্কে তথ্য নেওয়া এবং তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব:
এমআরপি ব্যবস্থা চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এবং পণ্যের মান উন্নত করতে সহায়তা করবে। এটি কেবল ক্রেতাকে ঠকানোর হাত থেকে রক্ষা করবে না, বরং একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যখন এই ব্যবস্থা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে, তখন আমাদের দেশেও এই পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
মো. মোজাম্মেল হক মৃধা, ই-কমার্স উদ্যোক্তা