শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শোয়েব সাম্য সিদ্দিক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫, ১২:০৭ এএম

ডলারের আধিপত্য ও বাংলাদেশের অর্থনীতি 

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫, ১২:০৭ এএম

ডলারের আধিপত্য ও বাংলাদেশের অর্থনীতি 

আজকের বিশ্বে কোনো দেশই ডলার ছাড়া শ্বাস নিতে পারে না। তেল কেনা, ঋণ শোধ কিংবা আমদানি-রপ্তানির সব ক্ষেত্রেই ডলারের অদৃশ্য শাসন বিস্তৃত। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই আধিপত্য কি চিরস্থায়ী? ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটি ‘অপরাজেয় শক্তি’ একদিন পতনের মুখে দাঁড়ায়। তাহলে কি ডলারের রাজত্বও ধীরে ধীরে সেই পথে এগোচ্ছে, নাকি বরং আরও গভীরভাবে শিকড় গাড়ছে বিশ্ব অর্থনীতির মাটিতে? 

বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির মধ্যে মার্কিন ডলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এটিকে ‘বিশ্বের রাজার মুদ্রা’ বলা হয়, এর পেছনে রয়েছে গভীর কারণ। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি ও আকার এত বিশাল যে, বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এটি এক ধরইের আস্থার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর, অনেক দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় পরিমাণে ডলার রিজার্ভ হিসেবে জমা রাখে। ফলে ডলারকে শুধু একটি মুদ্রা হিসেবে না দেখে, অনেক দেশ এটিকে তাদের জাতীয় অর্থনীতির রক্ষাকবচ মনে করে। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বড় বড় পণ্য যেমন তেল, গ্যাস, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের দাম নির্ধারণে ডলারের ব্যবহার। এই পেট্রোডলারের যুগে, প্রায় সব তেলবিক্রেতা দেশ তেল বিক্রির জন্য ডলারেই দাম চায়। তাই বিশ্বের অনেক দেশ বাধ্য হয় ডলার সংগ্রহ করতে এবং নিজেদের বাণিজ্য কার্যক্রম চালাতে।

সবশেষে, মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের কথা উল্লেখ না করলে হবে না। দেশ, কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীরা এই বন্ড কিনে তাদের অর্থ সুরক্ষিত রাখে এবং সেখানে থেকে নিয়মিত সুদ পায়। মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের এই নিরাপত্তা ডলারের প্রতি বিশ্বস্ততা তৈরি করে যা আর্থিক বাজারে ডলারের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। এসব কারণে ডলার বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রেটন উডস সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি ডলারের পেছনে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা থাকবে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে বেশি সোনা মজুত থাকায় বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের ওপর আস্থা তৈরি হয় এবং তা হয়ে ওঠে প্রধান মুদ্রা।

কিন্তু ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঘোষণায় (নিক্সন শক) সোনার সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এরপর ডলার পরিণত হয় ফিয়াট কারেন্সিতে, যার মূল্য কেবল মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে টিকে থাকে।

এই পরিবর্তনের পরও যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনীতি এবং তেল-গ্যাসসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল পণ্যের দাম ডলারে নির্ধারিত হওয়ায় এর আধিপত্য আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ‘পেট্রোডলার’ যুগের সূচনা করে।

২০০৮ সালের মন্দার পর থেকেই অনেক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ডলারের আধিপত্য ধীরে ধীরে কমতে পারে। ডলারের আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ দ্রুত বাড়ছে। সরকার বিপুল পরিমাণে ধার করায় বিনিয়োগকারীরা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কিত, আর ঋণের চাপ বাড়লে ডলারের ওপর আস্থাও কমে যায়। দ্বিতীয়ত, মার্কিন রাজনৈতিক অস্থিরতা সমস্যা তৈরি করছে। নীতি নির্ধারণে দোদুল্যমানতা অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আনে যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে। তৃতীয়ত, অন্যান্য মুদ্রার উত্থানও গুরুত্বপূর্ণ। ইউরো ও চীনের রেনমিন্বি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে, ফলে বিশ্ব ধীরে ধীরে ডলারের বিকল্প খুঁজছে।

এসব কারণ একসঙ্গে মিলিয়ে অনেকেই ধারণা করেন, ভবিষ্যতে ডলারের গুরুত্ব কমে আসতে পারে। তবে এখনো বিশ্বের অনেক দেশের কাছে ডলার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী মুদ্রা।

আসলে ডলারের বিকল্প হিসাবে এখনো তেমন কোনো স্থিতিশীল মুদ্রা নেই। উদাহরণস্বরূপ, ইউরো মুদ্রা অনেক দেশের যৌথ মুদ্রা হলেও ইউরো অঞ্চল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। এর কারণে ইউরো পুরোপুরি শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। অন্যদিকে, চীনের মুদ্রা রেনমিন্বি বা ইয়ুয়ান আন্তর্জাতিক বাজারে এখনো সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং স্বচ্ছভাবে বাণিজ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না। অর্থাৎ, রেনমিন্বি এখনো অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, যার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এখনো বেশি আস্থা রাখে ডলারে। সুতরাং, এই কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের আধিপত্য অব্যাহত রয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা

ছোট ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রা প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়, ফলে নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তারা সাধারণত ডলারে ঋণ নেয় ও লেনদেন চালায়, কারণ ডলার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল এবং বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ডলারের দাম বাড়লে তাদের ঋণের চাপ, আমদানি ব্যয় ও অর্থনৈতিক সংকটও বেড়ে যায়। তাই ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এসব দেশের জন্য বড় ঝুঁকি ও স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ।

বর্তমানে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম ইত্যাদি ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রাগুলো অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এগুলো কম্পিউটার কোডের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অনেকের মনে হয়, ভবিষ্যতে এই ডিজিটাল মুদ্রাগুলো ডলারের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এগুলো আন্তর্জাতিক  লেনদেনে ব্যবহার করা যায় এবং লেনদেন অনেক দ্রুত হয়। তবে এখনো বেশ কিছু বড় বাধা রয়েছে। প্রথমত, এই মুদ্রাগুলোর মূল্য খুব বেশি ওঠানামা করে, যা অনেক সময় বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। দ্বিতীয়ত, অনেক দেশ এখনো এই মুদ্রাগুলোর ব্যাপারে পরিষ্কার আইন তৈরি করেনি, তাই এগুলোকে বৈধ মুদ্রা হিসেবে পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এখনো সীমিত।

এসব কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সি ডলারের বিকল্প হিসেবে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

ভবিষ্যতে কী হতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামীতে ডলারের একক আধিপত্য কিছুটা কমতে পারে। বিশ্ব ধীরে ধীরে বহুমুদ্রা ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে- ইউরো, রেনমিন্বি ও অন্যান্য মুদ্রা বাণিজ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে। একইসঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা আন্তর্জাতিক লেনদেনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের বড় কারণ হলো ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। তাই স্বল্পমেয়াদি সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদি কৌশল জরুরি।

প্রথমত, ধাপে ধাপে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে বাজারে অযাচিত অস্থিরতা না তৈরি হয় এবং একাধিক বিনিময় হার ব্যবস্থার জটিলতা দূর হয়। একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট নীতি প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে আমদানি, ঋণ পরিশোধ ও জরুরি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ সহজ হয় এবং জনগণ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়।

দ্বিতীয়ত, বিলাসী পণ্যের অপ্রয়োজনীয় আমদানি ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে হবে যাতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমে এবং রিজার্ভ টেকসই থাকে। একইসঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন খাতকে প্রণোদনা ও নীতি-সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষত কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, ভোগ্যপণ্য, ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আমদানি-নির্ভরতা হ্রাস করা সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, রেমিট্যান্সকে অবৈধ বা অনানুষ্ঠানিক পথে আসা থেকে বিরত রাখতে প্রবাসীদের জন্য আকর্ষণীয় প্রণোদনা দিতে হবে এবং একইসঙ্গে দ্রুত ও সহজ ডিজিটাল চ্যানেল চালু করতে হবে। ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে স্বল্প খরচে ও ঝামেলাহীনভাবে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ তৈরি হলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করতে উৎসাহিত হবে। 

চতুর্থত, পোশাক খাত বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হলেও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য এর বাইরে নতুন খাত গড়ে তোলা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সফটওয়্যার, আউটসোর্সিং ও স্টার্টআপ রপ্তানিতে সুযোগ তৈরি করতে হবে; কৃষিতে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, শাক-সবজি ও হিমায়িত মাছের মতো পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। আর ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আন্তর্জাতিক মানে তৈরি করে নতুন বাজারে প্রবেশ করতে হবে। 

পঞ্চমত, ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ দমন, কর নেট সম্প্রসারণ ও ডিজিটালাইজেশন জরুরি।

সবশেষে, জনগণের আস্থা ফেরাতে স্বচ্ছ নীতি, বাজার মনিটরিং ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। সমন্বিত এই রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে ডলার নির্ভরতা কমবে, অর্থনীতি হবে আরও স্থিতিশীল এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হবে।

ডলার শুধু মুদ্রা নয় এটি বিশ্ব অর্থনীতির শক্তির প্রতীক। স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে দেশগুলো বাণিজ্য ও ঋণে ডলারের ওপর নির্ভরশীল হলেও এ নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কিন নীতি ও ডলারের ওঠানামা উন্নয়নশীল দেশকে সংকটে ফেলে তাই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে এর প্রভাব সতর্কভাবে বিবেচনা জরুরি।

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
গবেষক ও কলামিস্ট

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!