রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ফাহিম হাসনাত

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১২:৫৪ এএম

ডাকসু নির্বাচন: ট্যাগিংয়ের রাজনীতির মারপ্যাঁচে ছাত্রদলের পরাজয়

ফাহিম হাসনাত

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১২:৫৪ এএম

ডাকসু নির্বাচন: ট্যাগিংয়ের রাজনীতির মারপ্যাঁচে ছাত্রদলের পরাজয়

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বরাবরই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিষ্ঠানটি ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।

দুঃখজনক হলেও সত্য, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। প্রায় তিন দশক ধরে এ স্থবিরতা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিয়েছিল। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা পুনরায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি জানায়, ফলে প্রথম ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হয়ে বড় ধরনের চমক সৃষ্টি করেন। তারই ধারাবাহিকতায়, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত এ ডাকসু নির্বাচনকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন এবং ইতিবাচক অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অর্ধযুগেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসে ছিল উৎসবের আমেজ। প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটার শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। অতীতের ডাকসু নির্বাচনের মতো বড় ধরনের কোনো সংঘাত বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি শুভ লক্ষণ। এ শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেই প্রধান দুই প্যানেল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এনেছে। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, যা দেশের ছাত্ররাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের এ বিশাল সাফল্যের পেছনে ছিল তাদের সুশৃঙ্খল, সুপরিকল্পিত এবং সুদূরপ্রসারী কৌশল। তারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাসে কাজ করেছে, ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর যখন অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত ছিল, তখন শিবির অত্যন্ত কৌশলে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তাদের প্যানেলের নাম ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা এটিকে শিবিরের প্যানেল হিসেবেই বিবেচনা করেছে, যা তাদের একটি কৌশলগত সাফল্য। এ গোপনীয়তার কৌশল অবলম্বন করে তারা নিজেদের মূল পরিচয়কে কিছুটা আড়াল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের কৌশল পরিবর্তন করছে।

অন্যদিকে, দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রদলের পরাজয়ের পেছনে ছিল বেশ কিছু দুর্বলতা। তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব। ছাত্রদল তাদের নির্বাচনি অঙ্গীকারগুলো সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদলের চোখে পড়ার মতো কোনো কার্যক্রম ছিল না, যা তাদের জনপ্রিয়তা কমাতে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া ছাত্রদল তাদের প্রচারে ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ন্যারেটিভ’ ব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। এ ন্যারেটিভগুলো জুলাই অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের কাছে আর আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি, কারণ শিক্ষার্থীরা একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার দিকে ঝুঁকছে, যেখানে পুরোনো রাজনৈতিক বিভাজনগুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ক্ষেত্রেও ছাত্রদল পিছিয়ে ছিল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল, যেখানে ছাত্রদলের কার্যক্রম ছিল গৌণ। অনলাইনে সক্রিয় প্রচারণা, শিক্ষার্থীবান্ধব কনটেন্ট তৈরি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে শিবির অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জামায়াত-শিবিরের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এ বিজয়ের পেছনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে একটি নতুন ধারার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।

ডাকসু নির্বাচনকে অনেকেই ‘মিনি পার্লামেন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং এ নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ভিন্ন বার্তা দিতে পারে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহলে। যারা বাংলাদেশে ‘কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের’ কথা বলেন, তারা এ বিজয়কে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। তারা যেন নতুনভাবে বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য দিয়ে মোকাবিলা করা জরুরি।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। এটি বিএনপির জন্য একটি সুস্পষ্ট বার্তা। যদিও এ নির্বাচন সরাসরি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলবে না, এটি বিএনপি এবং তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলকে জনগণের মনোভাব বোঝার জন্য নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। তাদের অবশ্যই জনগণের চাহিদা বুঝে রাজনৈতিক কৌশল ও বক্তব্য ঠিক করতে হবে। ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীদের কর্মকা-ে নতুন রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের মতো নেতারা বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন, যা একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত।

এ নির্বাচনে জয়-পরাজয় একটি সাধারণ ঘটনা হলেও এর নেপথ্য ঘটনাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণ জরুরি। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের নিরঙ্কুশ বিজয় তাদের সুশৃঙ্খল ও সুপরিকল্পিত প্রচারণার ফসল। অন্যদিকে, ছাত্রদলের পরাজয় তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বুঝতে না পারার ফল। জুলাই অভ্যুত্থান এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা যে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা দেখিয়েছিল, এই ডাকসু নির্বাচন তার একটি প্রতিফলন। এটি প্রমাণ করে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন গতানুগতিক লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি নতুন ধরনের নেতৃত্বের সন্ধান করছে, যা তাদের শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীবান্ধব বিষয়ে বেশি মনোযোগী হবে।

দীর্ঘদিন পর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সব অংশগ্রহণকারী ও সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন। বিশেষ করে, নবনির্বাচিত ডাকসু ভিপি আবু সাদিক কায়েম, জিএস এসএম ফরহাদ, এজিএস মহিউদ্দিন খানসহ ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট এবং হল শাখাগুলোয় নির্বাচিত সবার প্রতি শুভ কামনা। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের এ নবযাত্রা অক্ষুণœ থাকবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

ফাহিম হাসনাত, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!