দুর্নীতি একটি সমাজের জন্য ক্যানসারের মতো। এটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা দেয় না, একই সঙ্গে নৈতিকতা, ন্যায়বিচার এবং মানুষের মৌলিক অধিকারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমাদের দেশের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুধবার রূপালী বাংলাদেশে পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদকে নিয়ে ‘মিস্টার টেন পারসেন্ট’ শিরোনামের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা আমাদের সামনে বিশাল একটি বাণিজ্যিক অনাচারের ছবি ফুটে উঠেছে। বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে এমন কোনো দুর্নীতি নেই, যা এই খালেদ মাহমুদের সময়ে হয়নি। ভারতের আদানির সঙ্গে চুক্তিসহ দেশি-বিদেশি শতাধিক চুক্তি স্বাক্ষর হয় খালেদ মাহমুদের সময়। সব ধরনের চুক্তিতে ১০ শতাংশ করে কমিশন নিতেন খালেদ মাহমুদ। এটি চরমভাবে উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা য়ায, দায়িত্বে থাকাকালীন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জার্মানি, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, ফ্রান্স, ইউএসএ, চেক রিপাবলিক, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, চীন ও সাউথ কোরিয়ায় ভ্রমণ করেন সরকারি খরচে। এখানেই শেষ নয়, চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েও চালিয়েছেন নানা তদবির বাণিজ্য। এসবের বিনিময়ে রাজধানীতেই শতকোটি টাকার একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে বিদেশে পাচার করেছেন বিপুল অর্থ। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর সময়ে ১২ হাজার ৬৭৮ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাট আয়কর নথিতে দেখান খালেদ মাহমুদ। দাম ২৪ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। ২১ কোটি টাকা শোধ করেন নগদে।
যদিও এর বাজারমূল্য আরও বেশি, বলছেন গোয়েন্দারা। এই ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগও নেন খালেদ মাহমুদ। কর দেন মাত্র ৯৬ লাখ টাকা। তবে টাকার উৎস আয়কর নথিতে নেই। পূর্বাচলে সরকারের কাছ থেকে জমিও নিয়েছেন খালেদ মাহমুদ। ২৫ নম্বর সেক্টরে তার প্লটটি ৭ কাঠার বেশি। জন্মস্থান ময়মনসিংহেও ৩ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে খালেদ মাহমুদের, যার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা। ব্যাংকে এফডিআর আছে সোয়া ২ কোটি টাকার। আছে কোটি কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছর হরিলুট চলেছে। বিশেষ আইনের সুযোগে দরপত্র ছাড়াই শতাধিক বিদ্যুৎ চুক্তি হয়েছে। পিডিবির চুক্তিতে অনেক ধরনের বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে। পদে পদে সুবিধা নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার নিয়ে গেছে আদানিসহ অন্যান্য কোম্পানি। যারা এসবের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। খালেদ মাহমুদের মতো মানুষেরা ওই আমলেও দাপটের সঙ্গে জীবনযাপন করেছেন, এই আমলেও করছেন, যা মানা কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া।’
এনবিআর ও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা ইউনিট ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে। যা ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কেন আগাম উদ্যোগ নেয়নি; কেন স্বপ্রণোদিতরূপে কার্যকর অনুসন্ধান চালায়নি। যেখানে প্রকাশ্য অভিযোগের সূত্র আছে, সেখানে তদন্ত দ্রুত, স্বচ্ছ এবং স্বাধীন হওয়া জরুরি; তা না হলে জনগণ ন্যায়ের প্রতি অনাস্থাগ্রস্ত হবে।
আমরা মনে করি, দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কার হওয়া জরুরি। বিশেষ করে, বিদ্যুৎ চুক্তি, বিশেষ আইন এবং সরাসরি দরপত্র ছাড়া হওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন করে দিতে হবে। প্রয়োজনে পুনরায় দরপত্র, মূল্য নিরীক্ষা করতে হবে।
সরকারের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং দ্রুতগতির অনুসন্ধান সম্পন্ন করে যথাযথ শাস্তি ও সম্পদ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, নাগরিক সংগঠন, গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভিযোগ যাচাই ও মানদ- নির্ধারণে সহযোগী হিসেবে রাখলে এই প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে।
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। দুর্নীতি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য বড় বাধা। দুর্নীতি নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার যদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে দুর্নীতিমুক্ত একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন