এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল এক কথায় চমকপ্রদ নয়, বরং হতাশাজনক। ২১ বছর পর গড় পাসের হার নেমে এসেছে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। প্রায় ৪১ শতাংশ পরীক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া শুধু পরীক্ষার ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার এক গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বিপুল হারে কমে এসেছে।
এই ফলাফলের পেছনে নিছক ‘দুর্ভাগ্য’ বা ‘দুর্বল প্রস্তুতি’ দায়ী নয়। বরং এটি দীর্ঘদিনের ভুল শিক্ষানীতি, অদক্ষ পাঠদান, কোচিংনির্ভরতা, মানহীন পাঠ্যবই এবং একরকম ‘সংখ্যার পেছনে দৌড়ানোর সংস্কৃতি’র ফলাফল।
দীর্ঘদিন আমরা পাসের হার এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আমরা ‘পাসের হার’কেই সাফল্যের প্রতীক হিসেবে দেখেছি, আর এতে করে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জায়গা চাপা পড়ে গেছে। আজ তার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীদের, অভিভাবকদের এবং পুরো জাতিকে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। এটি কি শুধু শিক্ষার্থীদের অযোগ্যতা, নাকি শিক্ষকদের অদক্ষতা, নাকি দুর্বল পাঠ্যক্রম, ভুল মূল্যায়ন পদ্ধতি বা প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার বহির্প্রকাশ?
মাদ্রাসা বোর্ডে যেখানে পাসের হার ৭৫ শতাংশের বেশি, সেখানে কুমিল্লা বোর্ডে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪৮ শতাংশে। বিভিন্ন বোর্ডে পাসের হারে এত বড় পার্থক্য শিক্ষা ব্যবস্থার সাম্য ও মানসম্পন্নতা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
এই ফলাফলকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এখন প্রয়োজন গভীর ও নিরপেক্ষ তদন্ত। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষক, অভিভাবক, এমনকি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার।
টানা ২১ বছর পর এসে এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এমন ফলাফল যে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরের গভীর সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
এ বছর শিক্ষার্থীরা যে হারে ফেল করেছে, তা শুধু শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা নয়; এটি শিক্ষানীতি, পাঠদানের কৌশল ও মূল্যায়ন পদ্ধতির সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিফলন। করোনা-পরবর্তী সময়েও পাঠ্যসূচি সংকোচন, অনলাইন ক্লাসের ঘাটতি ও পর্যাপ্ত পুনরাবৃত্তি না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাস্তব জ্ঞান ও প্রয়োগভিত্তিক মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো দক্ষ শিক্ষক ঘাটতি, পর্যাপ্ত ল্যাব বা লাইব্রেরি সুবিধার অভাব এবং পরীক্ষার আগে কোচিং-নির্ভরতার প্রবণতা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বিকৃত করছে।
এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষক, অভিভাবক ও নীতিনির্ধারক, সবারই উচিত এই ফলাফলের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা। শুধু পাসের হার বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম পদক্ষেপ না নিয়ে শেখার মান উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। পরীক্ষার পদ্ধতি আধুনিক করতে হবে, যেখানে মুখস্থ নয়, বোঝার ওপর গুরুত্ব থাকবে। শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিতা জোরদার করতে হবে।
শিক্ষা হলো একটি জাতির ভবিষ্যতের ভিত্তি। সেই ভিত্তি যদি দুর্বল হয়ে যায়, তবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সব স্বপ্নই ভেস্তে যাবে। তাই এবারের ফলাফলকে ‘বিপর্যয়’ হিসেবে নয়, ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে নিতে হবে, যাতে আমরা এখনই শিক্ষা ব্যবস্থার গলদগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নিতে পারি।
আমরা মনে করি, এই ফল বিপর্যয় একটি সতর্কবার্তা। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মুখস্থনির্ভরতা, প্রশ্নফাঁস নির্ভরতাসহ শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে জমে থাকা গলদ কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখন সময় এসেছে, সৎ সাহসে সেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও কার্যকর শিক্ষা সংস্কারের পথে এগিয়ে যাওয়ার। না হলে আগামী বছর হয়তো আরও ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।