গাজায় বিধ্বংসী যুদ্ধের দুই বছর পর অবশেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু শান্তির এই মুহূর্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং নতুন ছয়টি বড় রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জের সূচনা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সমালোচকেরা বলছেন, যুদ্ধের আড়ালে নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ও বিচারসংক্রান্ত সংকট থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর সেসব সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এমনকি এই যুদ্ধবিরতিকেও তিনি ‘জয়’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, যদিও অনেকে একে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাপের ফল বলে মনে করছেন।
সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিনকাসের ভাষায়, এটি ছিল সাজানো এক সমাপ্তি, যা ওয়াশিংটনের ধৈর্যের শেষ সীমা টেনে এনেছে।
তাহলে যুদ্ধ শেষ হলে নেতানিয়াহুর সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসছে? নিচে ছয়টি বড় দিক তুলে ধরা হলো—
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন
ইসরায়েল আজ বিশ্বমঞ্চ থেকে বিচ্ছিন্ন। গত দুই বছরে গাজায় ৬৭ সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, লাখো মানুষ দুর্ভিক্ষে ভুগছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। যতদিন গাজায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হবে, ততদিন এই বিচ্ছিন্নতা দূর হবে না।
গত সেপ্টেম্বরে নেতানিয়াহু ‘সুপার স্পার্টা’ (প্রাচীন গ্রিক সামরিক সাম্রাজ্য) গঠনের স্বপ্ন দেখিয়ে একপ্রকার আত্মনির্ভর, যুদ্ধনির্ভর ইসরায়েলের রূপরেখা দেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা সেটি ভালোভাবে নেননি। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ ধসে পড়ে, শেকেল দুর্বল হয়ে যায়। ইসরায়েলের ব্যবসায়ী সংগঠন ইসরায়েল বিজনেস ফোরাম স্পষ্ট করে জানায়, ‘আমরা স্পার্টা নই।’
ভেঙে পড়তে পারে ডানপন্থি জোট
গাজা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ায় নেতানিয়াহুর ডানপন্থি জোট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নেতানিয়াহু তা ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। যুদ্ধকালে তিনি মূলত ডানপন্থি ও ধর্মীয় চরমপন্থিদের ওপর নির্ভর করেছেন। বিশেষ করে, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সমর্থনে। তাঁরা যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করলেও এখনো জোটে রয়েছেন।
তবে আশঙ্কা রয়েছে, তাঁরা জোট ছেড়ে দিতে পারেন। সে সম্ভাবনা এড়াতে নেতানিয়াহু নতুন আইনের প্রস্তাব আনছেন, যেখানে উগ্রবাদী ইহুদি শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক সেনা নিয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এতে তিনি আশা করছেন, ধর্মীয় দলগুলো আবারও তাঁর জোটে ফিরে আসবে।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে কি দোষী সাব্যস্ত হবেন নেতানিয়াহু
এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাস কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা শুনছেন। দোষী প্রমাণিত হলে এর দায়ও পড়বে নেতানিয়াহুর ওপর।
যদিও রায় দিতে এখনো সময় লাগবে। আইসিসির মামলার নিষ্পত্তি অনিশ্চিত আর আইসিজের রায় ২০২৭ সালের আগে আসার সম্ভাবনা নেই। তবে দোষী সাব্যস্ত হলে আইসিসি সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ড দিতে পারেন।
ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুকে ছেড়ে যাবেন
এ সম্ভাবনাও বেশ জোরালো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক মিত্র। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহায়তারও সীমা রয়েছে।
২০২১ সালে নেতানিয়াহু যখন জেতার সঙ্গে সঙ্গে জো বাইডেনকে জয়ের শুভেচ্ছা জানান, তখন ট্রাম্প নাকি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়।
সম্প্রতি দোহায় হামাস প্রতিনিধিদের ওপর ইসরায়েলি হামলার পর ট্রাম্প নাকি চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘সে (নেতানিয়াহু) আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে!’ তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ‘গাজায় পুনরায় ইসরায়েলি সেনা মোতায়েন আমার অনুমতি ছাড়া হবে না।’ সুতরাং, যদি নেতানিয়াহু আবার আগ্রাসী পদক্ষেপ নেন, ট্রাম্পের সমর্থন হারানো অবশ্যম্ভাবী।
৭ অক্টোবরের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ, এর তদন্ত হবে কি
এখন ইসরায়েলে এ বিষয় ক্রমেই সম্ভাব্য হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হয় এবং প্রায় ২৫০ জনকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনার পর ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মারাত্মক ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। পরে তাদের প্রধানেরা পদত্যাগ করেন।
নেতানিয়াহু নিজের সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বারবার এ তদন্তের বিরোধিতা করেছেন। তবে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছেন, আর তদন্ত ঠেকানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সরকারকে ৩০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
নেতানিয়াহুর কি জেলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে
হ্যাঁ, সেটি পুরোপুরি সম্ভব। ট্রাম্প নিজেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, গাজা যুদ্ধ আসলে নেতানিয়াহুর চলমান দুর্নীতির বিচার থেকে দৃষ্টি সরানোর উপায় ছিল।
নেতানিয়াহু বর্তমানে তিনটি দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত—ঘুষ, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
এর আগে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগকে সিগারেট ও শ্যাম্পেইন কেলেঙ্কারির জন্য নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া থামেনি এবং যুদ্ধবিরতির পর সেটি আরও গতি পেতে পারে। তাই বলা যায়, নেতানিয়াহুর ক্ষেত্রেও সে দেশের আইন থেমে থাকবে না।