ঢাকা শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

ব্ল্যাক বোর্ডের ধুলায় ঢাকা সংগ্রামের ইতিহাস

বিল্লাল হোসেন সরদার, শিক্ষক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদ- হলো সেই শিক্ষক সমাজ, যারা মানুষ গড়ার ব্রত নিয়ে জীবন কাটান। তাদের হাতেই নির্মিত হয় ভবিষ্যতের নাগরিক, তৈরি হয় জাতির মেধার ভিত্তি। অথচ এই মানুষগুলোর এক বিশাল অংশ, বিশেষত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা, নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার পেতে যে দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করেছেন, তা এক রুদ্ধশ্বাস ইতিহাস। পাকিস্তান আমলে মাত্র পাঁচ টাকা ‘মহার্ঘ্য ভাতা’ থেকে শুরু করে আজকের শতভাগ বেতন-ভাতা পাওয়ার যাত্রাপথটি মূলত অবিচল আন্দোলন, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

পাকিস্তান আমলে শিক্ষকদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তখন বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক মাত্র পাঁচ টাকা ‘মাগগি ভাতা’ পেতেন, যা দিয়ে এক কাপ চা ও দুটি বিস্কুট কেনার পর আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই আন্দোলনের ফলেই ভাতার পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো হয়। মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য ১৫ টাকা ও কলেজ শিক্ষকদের জন্য ২০ টাকা নির্ধারিত হয়। কিন্তু তাতে তাদের জীবনমানের কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসে না। তখনো শিক্ষা ছিল পেশার চেয়ে অধিকতর এক আত্মনিয়োগের কাজ, যেখানে শিক্ষকরা সম্মান পেতেন সমাজে, কিন্তু জীবনযাপন করতেন অনিশ্চয়তার মধ্যে।

ষাটের দশকে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে শিক্ষক সমাজের অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হলেও প্রকৃত অর্থে উন্নতি হয়নি। কলেজশিক্ষকেরা মাসিক ৩০ টাকা ও মাধ্যমিক শিক্ষকেরা ২০ টাকা অনুদান পেতেন। সব পদবি-নির্বিশেষে একই অনুদান ছিল, যা তাদের যোগ্যতা ও দায়িত্বের সঙ্গে বেমানান ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলেও শিক্ষকদের ভাগ্য তেমন ফেরেনি। তখন কলেজশিক্ষকেরা ৫০ টাকা এবং স্কুলশিক্ষকেরা ৩০ টাকা পেতেন। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই পরিমাণ টাকায় সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ক্রমেই অসন্তোষ বাড়তে থাকে।

১৯৭৭ সালে সরকার শিক্ষকদের জন্য প্রথম বড় আর্থিক সংস্কার করে। কলেজের অধ্যাপকরা ২০০ টাকা এবং মাধ্যমিক স্তরের স্নাতকোত্তর শিক্ষকরা ১১০ টাকা ভাতা পেতে শুরু করেন। এটি ছিল বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক উন্নয়নের প্রথম দৃশ্যমান পদক্ষেপ। আশির দশকে এসে শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে। ১৯৮০ সালে প্রথমবারের মতো বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হন। একই সঙ্গে সরকারি তহবিল থেকে তাদের বেতনের ৫০ শতাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। এই পদক্ষেপটি ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা, কারণ এর মধ্য দিয়েই বেসরকারি শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আসেন।

১৯৮২ সালে শিক্ষকদের জন্য ১৫ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা চালু হয়, যা আন্দোলনের মুখে পরের বছর ৩০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৪ সালে সূচনা হয় এমপিও (গড়হঃযষু চধু ঙৎফবৎ) প্রথার। সরকারি অংশের অর্থ সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে শিক্ষকদের হাতে পৌঁছাতে শুরু করে, যা দুর্নীতি ও অনিয়ম কমায়। ১৯৮৬ সালে মেডিকেল ভাতা ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় উন্নীত হয় এবং সরকারি বেতনের অংশ ৭০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এ সময় শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণে একটি ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এসব পরিবর্তন শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

নব্বইয়ের দশককে বলা যায় আন্দোলনের দশক। ১৯৯৪ সালে শতভাগ বেতন দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষক আন্দোলন শুরু হয়। তারা পাবলিক পরীক্ষা বর্জন, ধর্মঘট ও হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি নেন। আন্দোলনের চাপে সরকার মেডিকেল ভাতা ১৫০ টাকায় উন্নীত করে এবং টাইম স্কেল সুবিধা দেয়। ১৯৯৫ সালে সরকারি অংশ ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৯৭ সালে ক্ষমতাসীন সরকার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়Ñবেসরকারি শিক্ষকরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তাদের সরকারি অংশ সরাসরি ব্যাংকে দেওয়া হবে। এতে দুর্নীতি কমে, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষকের মর্যাদা আরও দৃঢ় হয়। তবে এই সময় শিক্ষক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়, যা আন্দোলনের ঐক্যকে দুর্বল করে তোলে।

২০০০-২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়টি ছিল বেসরকারি শিক্ষকদের অর্জনের স্বর্ণযুগ। ২০০০ সালে সরকারি বেতনের অংশ ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০০২ সালে অবসর সুবিধা (পেনশন) এবং উৎসব ভাতা চালু হয়। এর আগে পর্যন্ত শিক্ষকেরা চাকরি শেষে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক নিরাপত্তা পেতেন না। ২০০৬ সালে আসে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনÑবেতনের সরকারি অংশ ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এটি ছিল দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল এবং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

২০১০-এর পরবর্তী সময়েও শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া চলতে থাকে। ২০১২-১৩ সালে বাড়িভাড়া ৩০০ টাকা এবং মেডিকেল ভাতা ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৫ সালে তারা অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৬ সালে বাড়িভাড়া এক হাজার টাকা ও মেডিকেল ভাতা ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়। বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী শতভাগ বেতন, উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পাচ্ছেন। তবুও তাদের অভিযোগ, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মতো বাড়িভাড়া ভাতা তারা সম্পূর্ণভাবে পাচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে এখনো একটি বৈষম্য রয়ে গেছে, যা তাদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষের কারণ।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৫-৩০ হাজার বেসরকারি স্কুল ও কলেজ রয়েছে, যেখানে প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মরত। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাজারেরও কম। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আজও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। শিক্ষা হলো রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার, আর শিক্ষকেরাই সেই অধিকার বাস্তবায়নের মূল কারিগর। অথচ তারা এখনো নানাবিধ বৈষম্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটান। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকলেও আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার পূর্ণ নিশ্চয়তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

পাকিস্তান আমলের মাত্র পাঁচ টাকার মহার্ঘ্য ভাতা থেকে শুরু করে আজকের শতভাগ বেতনের যাত্রাপথ আসলে এক লড়াইয়ের গল্প। প্রতিটি উন্নতি এসেছে ত্যাগ, সংগ্রাম ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে। এই ইতিহাস শুধু শিক্ষকদের নয়, এটি বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক প্রতীকী ইতিহাসও বটে। শিক্ষকরা যদি না লড়তেন, তবে আজও হয়তো তারা সেই পাঁচ টাকার গ-ির মধ্যেই বন্দি থাকতেন। কিন্তু ত্যাগের এই ধারাবাহিকতা তাদের সম্মানিত করেছে, দিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

তবুও এই দীর্ঘ পথচলার শেষে প্রশ্ন থেকে যায়, শিক্ষকরা কি তাদের প্রাপ্য মর্যাদা সত্যিই পেয়েছেন? জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তি ও শতভাগ বেতন-ভাতা নিশ্চয়ই বড় অর্জন, কিন্তু সরকারি খাতের কর্মচারীদের তুলনায় তাদের সুযোগ-সুবিধা এখনো সীমিত। বেসরকারি শিক্ষকরা বারবার আন্দোলনের পথে নেমেছেন, কারণ তারা শুধু অর্থের দাবি করেননিÑচেয়েছেন সম্মান, স্থিতিশীলতা ও মর্যাদা। আজ প্রয়োজন রাষ্ট্রের আন্তরিক মনোযোগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যাদের কাঁধে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের দায়িত্ব, তাদের জীবন যেন না থাকে অবহেলা ও বৈষম্যের মধ্যে। শিক্ষা কেবল পাঠ্যবইয়ের বিষয় নয়, এটি এক নৈতিক ও সামাজিক চুক্তি, যেখানে রাষ্ট্র তার শিক্ষককে মর্যাদা দিলে তবেই জাতি আলোকিত হতে পারে।

বিল্লাল হোসেন সরদার, শিক্ষক ও কলাম লেখক