বাংলাদেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনে বড় ধরনের পুনর্গঠন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘ আট বছর পর সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দুই পৃথক বিভাগ, ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ’ এবং ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’কে একীভূত করে পুনরায় একটি একক মন্ত্রণালয়ে রূপ দিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ, যা দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
২০১৭ সালে এই দুই বিভাগে বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি ও সেবাদান প্রক্রিয়াকে আরও বিকেন্দ্রীভূত করা। কিন্তু বাস্তবে, এই দ্বৈত কাঠামো কাক্সিক্ষত সুফল আনতে পারেনি। বরং দায়িত্বের জটিলতা, সমন্বয়ের ঘাটতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্বৈত সিদ্ধান্তের কারণে স্বাস্থ্য খাতের প্রশাসনিক গতি কমে গিয়েছিল। মাঠপর্যায়ে একই কর্মসূচি দুটি বিভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় বিভ্রান্তি ও বিলম্ব বেড়েছে।
এই বাস্তবতায় সরকারের সিদ্ধান্ত এসেছে একীভূতকরণের মাধ্যমে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে। প্রশাসনিক পুনর্গঠন কমিটি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ, সব সংস্থা একমত যে, স্বাস্থ্য খাতে দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে একক কাঠামোই সবচেয়ে উপযোগী সমাধান। সরকার সেই সুপারিশ অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা একদিকে প্রশাসনিক সরলতা আনবে, অন্যদিকে জনসেবার মান নিশ্চিত করবে।
একীভূত কাঠামোর ফলে এখন থেকে একই সচিবের অধীনে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নার্সিং, পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃস্বাস্থ্যসহ সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত হবে, বাজেট ব্যবহারে স্বচ্ছতা বাড়বে এবং সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় সুফল হবে সেবার গুণগত মানে, যেখানে একই দিকনির্দেশনার অধীনে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক প্রশিক্ষণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সমন্বিতভাবে পরিচালিত হবে।
একীভূত মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় সুফল পাবেন দেশের সাধারণ মানুষ। মাঠপর্যায়ে একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী যাতে প্রশাসনিক জটিলতায় না পড়ে সরাসরি সেবা দিতে পারেন, এই লক্ষ্যেই একীভূত কাঠামো কার্যকর হতে পারে। একই সঙ্গে মেডিকেল শিক্ষা, নার্সিং প্রশিক্ষণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমও একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় আসবে। ফলে মানবসম্পদ উন্নয়ন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, সব ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, এই পুনর্গঠন হলে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা ও গতি বাড়বে। নীতিমালা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে দীর্ঘ ব্যবধান ছিল, তা কমে যাবে। একই সঙ্গে বাজেট বরাদ্দ ও প্রকল্প অনুমোদনের সময়ও কমে আসবে, যা সরাসরি জনসেবার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
এই পুনর্গঠন কেবল একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; এটি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনার এক নতুন সুযোগ। জনগণ প্রত্যাশা করছে, এর ফলে সেবা হবে আরও সহজলভ্য, সময়োপযোগী ও মানবিক।
তবে এই পুনর্গঠনের সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবায়নের দক্ষতার ওপর। একীভূত মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমন্বিত ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা, স্পষ্ট দায়িত্ববণ্টন এবং মাঠপর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনিক ঐক্য তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা নাগরিকের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বাস্তবতায় প্রতিফলিত হবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, মানবসম্পদের অভাব, বাজেট সীমাবদ্ধতা, অবকাঠামোগত ঘাটতি ও প্রশাসনিক জটিলতা। এসব বিবেচনায় এই একীভূত কাঠামো সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত কেবল প্রশাসনিক পুনর্গঠন নয়, এটি একটি মানসিক পরিবর্তনের প্রতীক, যেখানে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি, দ্রুত সিদ্ধান্ত ও জনমুখী নীতিনির্ধারণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এই পুনর্গঠনের ফলে চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে যে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল, তা দূর হবে। একই সঙ্গে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ও কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রমে সমন্বয় ফিরবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশাসনিক সময়ক্ষেপণ কমে সেবার গতি বাড়বে। যা সরাসরি নাগরিকের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকারের এই সময়োপযোগী পদক্ষেপ দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই পদক্ষেপ যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সেবার মান নিশ্চিত করার পথে দেশ এগিয়ে যাবে আরও এক ধাপ। সেই সঙ্গে আমরা হাঁটব একটি সুসংহত, দক্ষ ও মানবিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে।