সম্প্রতি বৈশ্বিক পর্নো সাইটে বাংলাদেশি এক যুগলের নাম উঠে এসেছে, যারা আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে অষ্টম স্থানে জায়গা পেয়েছেন। এক বছরে তাদের ভিডিও দেখা হয়েছে দুই কোটিরও বেশি বার। অবশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বান্দরবান থেকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনাটি যতটা চাঞ্চল্যকর, তার চেয়ে বেশি লজ্জাজনক। বাংলাদেশ নামটি যে দেশের সৃজনশীলতা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সঙ্গে জড়িত, সেই দেশের নাগরিকরা যখন পর্নো শিল্পে নিজেদের বিক্রি করে দেয়, তখন এটি কেবল অপরাধ নয়, বরং সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
পর্নো এমন এক বিষয়, যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে অনেকে সংকোচবোধ করেন। কিন্তু নীরবতা সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে। সমাজের রক্ষণশীলতার কারণে এ বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ না হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম কৌতূহলের জায়গা থেকে পর্নো জগতে পা রাখে। তারা জানে না এই আকর্ষণ এক সময় মানসিক আসক্তিতে রূপ নেয়। বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধ, পারিবারিক সম্পর্ক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পর্নোর এই উন্মুক্ততা একেবারেই বেমানান। কিন্তু তবুও পর্দার আড়ালে এই বিষয়টি ভয়ংকরভাবে বিস্তৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির ইতিহাস খুব নতুন নয়। আশির দশকে ভিসিআর বা ভিডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে গোপনে নীল ছবির আমদানি শুরু হয়। পুরান ঢাকার গলিতে, হাটে-বাজারে গোপন বিক্রেতারা এসব ছড়াত। পরে ইন্টারনেটের বিকাশে পর্নোগ্রাফি নতুন রূপ নেয়। আর এখন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিগ্রামের যুগে এটি হাতের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। সামান্য মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট থাকলেই যে কেউ পর্নো ভিডিও তৈরি, আপলোড বা প্রচার করতে পারছে। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা পর্নো শিল্পকে দেশব্যাপী এক অদৃশ্য ব্যবসায় পরিণত করেছে।
২০২৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ মানুষ পর্নো সাইটে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশই ১৮-৩০ বছর বয়সি তরুণ। শুধু বিদেশি কনটেন্ট নয়, এখন স্থানীয় কনটেন্টও বেড়ে গেছে বিপুল হারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মাসে অন্তত ৩০০টির বেশি নতুন পর্নো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিগ্রামে আপলোড হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, বেকারত্ব, এবং অনলাইন আয়ের মোহ তরুণদের এই বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিচ্ছে। এখন এক ক্লিকেই যে কেউ নিজের শরীরকে বাজারে নামিয়ে ফেলতে পারে যা এক সময় অকল্পনীয় ছিল।
বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক প্রসারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অত্যন্ত কম মূল্যে দ্রুত গতির ইন্টারনেট ডেটা এবং সহজলভ্য স্মার্টফোন। স্বল্প আয়ের বা গ্রামীণ এলাকার তরুণদের হাতেও এখন স্মার্টফোন ও সস্তা ইন্টারনেট রয়েছে। এই প্রযুক্তির সহজলভ্যতা একদিকে যেমন ইতিবাচক, তেমনি অন্যদিকে এটি বিনোদনের নামে পর্নো আসক্তির পথ খুলে দিয়েছে।
বান্দরবানে গ্রেপ্তার হওয়া যুগল শুধু ভিডিও আপলোডই করতেন না, বরং তারা পুরো একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করতেন। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের কাজের প্রচার চালাতেন, নতুনদের আহ্বান জানাতেন, এবং প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণদের ফাঁদে ফেলতেন। তারা ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ নাম দিয়ে পর্নোকে বৈধ কর্ম হিসেবে প্রচার করতেন। তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে শতাধিক তরুণ যুক্ত ছিল বলে জানা গেছে। এটি কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং একটি সংগঠিত অনলাইন অপরাধচক্রের অংশ, যা তরুণ সমাজকে দ্রুত ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পর্নোগ্রাফি এক ধরনের মানসিক নেশা। প্রথমে কৌতূহল থেকে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তিতে পরিণত হয়। পর্নো দেখার ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিকের অতিরিক্ত নিঃসরণ হয়, যা অল্প সময়ের সুখ দেয় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য নষ্ট করে। এর ফলে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও যৌনতা থেকে মানুষ বিমুখ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ২০২৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮-২৫ বছর বয়সি তরুণদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ নিয়মিত পর্নো দেখে, যার প্রভাব তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, পড়াশোনা ও সামাজিক আচরণে মারাত্মকভাবে পড়ছে।
পর্নোগ্রাফির বিস্তারে ফেসবুক, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং বিভিন্ন ভিডিও হোস্টিং প্ল্যাটফর্মের একটি বড় দায় রয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায়শই স্থানীয় আইন ও নৈতিকতা উপেক্ষা করে পর্নো কনটেন্ট প্রচারের সুযোগ দেয়, যার প্রধান কারণ হলো বেশি ট্র্যাফিক ও মুনাফা। সরকারের উচিত এই আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনা এবং তাদের বাধ্য করা যাতে তারা স্থানীয় আইন অনুসারে আপত্তিকর কনটেন্টগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিল্টার ও ব্লক করে।
পর্নোগ্রাফি কেবল স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক ক্ষেত্রে এটি সাইবার বুলিং ও প্রতিশোধমূলক পর্নোগ্রাফির (জবাবহমব চড়ৎহ) মাধ্যমে তরুণীদের জীবনে অভিশাপ ডেকে আনে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটলে অথবা অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রতারকরা সম্মতি ছাড়া সংবেদনশীল ছবি বা ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। এর ফলে ভুক্তভোগী তরুণীরা মারাত্মক মানসিক আঘাত, সামাজিক লাঞ্ছনা ও এমনকি আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
পর্নো শুধু ব্যক্তিগত নেশা নয়, এটি পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোকেও দুর্বল করে দেয়। নিয়মিত পর্নো দেখার ফলে অনেকেই বাস্তব জীবনের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। নারীর প্রতি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, যা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার মানসিক মূলে প্রভাব ফেলে। মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, অতিরিক্ত পর্নো দেখা একাকিত্ব, হতাশা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ায়। সমাজবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘ডিজিটাল অবক্ষয়’ বলছেন যেখানে মানুষ বাস্তবতা থেকে পালিয়ে ভার্চুয়াল বিকৃতি খুঁজে নেয়।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পর্নোগ্রাফি এক ভয়াবহ পাপ। ইসলাম, খ্রিষ্টান ও হিন্দু প্রত্যেক ধর্মেই যৌনতার পবিত্রতা ও সংযমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামে বলা হয়েছে, ‘চোখের সংযম রাখ, কারণ তা হৃদয়ের পবিত্রতা রক্ষা করে।’ কিন্তু পর্নো সংস্কৃতি সেই সংযমকে ধ্বংস করে দেয়। এটি মানুষকে লালসার দাসে পরিণত করে, যেখানে নৈতিকতা ও আত্মসংযম বিলীন হয়ে যায়। সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা দুর্বল হয়ে পড়লে এই ধরনের অপরাধ বাড়ে, এবং মানুষ নিজের লজ্জা বোধ হারিয়ে ফেলে।
আজকের তরুণরা অর্থ ও জনপ্রিয়তার মোহে এমন অনেক পথ বেছে নিচ্ছে, যা একসময় কল্পনাতেও আসত না। কেউ ইউটিউব বা অনলাইন কনটেন্ট বানায়, কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে বিক্রি করে। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা তরুণদের ভুল বার্তা দিচ্ছে, যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনই সফলতা। কিন্তু এই অন্ধ দৌড়ে তারা ভুলে যাচ্ছে নৈতিকতা, মানবিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের পাঠ। পর্নো তারকা হয়ে যে খ্যাতি আসে, তা মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায় কিন্তু যে লজ্জা ও দাগ থেকে যায়, তা সারা জীবনের।
তরুণদের পথভ্রষ্টতার পেছনে পারিবারিক অবহেলাও বড় ভূমিকা রাখে। সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা না করা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা উদাসীনতা সবই তাদের একা করে তোলে। একাকিত্ব থেকেই তারা ভার্চুয়াল জগতে পালিয়ে যায়। পর্নোগ্রাফির মতো বিষাক্ত বিনোদন তখন তাদের কাছে আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা, বয়সোপযোগী যৌনশিক্ষা দেওয়া, এবং খোলামেলা আলোচনা তৈরি করা। নীরবতা বা লজ্জা নয় বোঝাপড়াই হতে হবে মূলশক্তি।
বাংলাদেশে ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ অনুযায়ী, পর্নো তৈরি, প্রচার বা সংরক্ষণ করা দ-নীয় অপরাধ। এই আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং আর্থিক জরিমানার বিধান রয়েছে। তথাপি, ইন্টারনেটের জগতে এই আইন প্রয়োগ জটিল। সাইবার অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে পর্নো-সংক্রান্ত অপরাধে ৩৭১টি মামলা রুজু হয়েছে, কিন্তু দ-প্রাপ্তের সংখ্যা মাত্র ১৮ জন। এটি দেখায়, আইন যতই কঠোর হোক না কেন, বাস্তবায়নের দুর্বলতা থাকলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই যায়।
পর্নো আসক্তি রোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শিক্ষা ও সচেতনতা। স্কুল পর্যায়ে যৌনতা নিয়ে সঠিক শিক্ষা না থাকলে তরুণরা বিকৃত উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। বয়সোপযোগী যৌনশিক্ষা মানে অশ্লীলতা নয়, বরং শালীনভাবে মানবদেহ, সম্পর্ক ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা। বাংলাদেশে এখনো অনেক বিদ্যালয়ে যৌনতা নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ধরা হয়, ফলে শিক্ষার্থীরা গোপনে ইন্টারনেটের সাহায্য নেয়। এখন সময় এসেছে পাঠ্যক্রমে যৌনতাবিষয়ক স্বাস্থ্য শিক্ষা যুক্ত করার।
যারা ইতোমধ্যে পর্নো আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের প্রতি সামাজিক সহানুভূতি প্রয়োজন। তাদের অপরাধী নয়, বরং রোগী হিসেবে দেখা উচিত। মনোচিকিৎসা, কাউন্সেলিং এবং সামাজিক পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরকার ও এনজিওগুলো যদি যৌথভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে এ বিষয়ে বিশেষ কাউন্সেলিং চালু করে, তাহলে অনেক তরুণের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। কারণ আসক্তি মানেই অপরাধ নয় এটি এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, যার চিকিৎসা সম্ভব।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে, কিন্তু উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোর নয়, মানুষের মনন ও নৈতিকতারও প্রয়োজন। পর্নোগ্রাফির এই অন্ধকার আসক্তি যদি আমরা এখনই থামাতে না পারি, তাহলে এক প্রজন্ম ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে যাবে। আমাদের সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে আইনি কঠোরতা, শিক্ষার সংস্কার, এবং নৈতিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে। এই লজ্জাজনক আসক্তি থেকে তরুণ সমাজকে ফিরিয়ে আনাই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক দায়িত্ব।
মো. নূর হামজা পিয়াস
কলামিস্ট ও সমাজকল্যাণ বিশ্লেষক