ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

কঠিন সময়ে দেশ: যথা অবস্থানে সরকার-সেনাবাহিনী

রিন্টু আনোয়ার সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ১১:৩৯ পিএম

সামনে নির্বাচন, ব্যাপক প্রস্তুতিতে সরকার। ট্রায়াল চলছে গুম-খুনের বিচারের। এতে অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের বিচার শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা, গুজব-গুঞ্জন, শঙ্কার মধ্যে। এ ছাড়াও আরও নানা কারণে কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ। কে কোন দিকে কাকে শিকার করছে, দেশকে কোন অস্থিরতায় ফেলার ছক করছে, তার ইয়ত্তা নেই। এর আগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি স্থাপনায় ঘটেছে ভয়াবহ অগ্নিকা-। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনিবার্যভাবে কঠোর অবস্থান নিতে হয়েছে সরকারকে। সামনে আরও কোনো অঘটনের শঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন-কেপিআই) নিরাপত্তায় জোর দেওয়া হয়েছে।

দেশে এখন কেপিআইভুক্ত স্থাপনা ৫৮৭টি। সংসদ ভবন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বঙ্গভবন, সচিবালয়, মেট্রোরেল বিশেষভাবে কেপিআইভুক্ত। নির্বাচন সামনে রেখে এমনিতেই একটা চ্যালেঞ্জ ঘুরছে। তার ওপর যোগ হচ্ছে একের পর এক অঘটনের সিরিজ। সেইসঙ্গে স্পর্শকাতর বিষয় গুমে জড়িত অভিযোগে বিগ শট সেনা কর্মকর্তাদের বিচার। যা নিয়ে নানা কথা চাউর হচ্ছে সমানে। কেবল র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসর ছুটিতে); র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম নন; ডিজিএফআইয়ের সাবেক তিনজন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকীও বিচারের কাঠগড়ায়। আদালতকে তাদের বিষয়ে নতুন করে কোনো রুলিং দিতে হয়নি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিতে হয়নি। বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির না হলে বা তাদের হাজির না করলে দুটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। মামলা তিনটির মধ্যে দুটি হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। আসামিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাও দৃশ্যমান হলো। সেনাবাহিনীর দিক থেকে বিচার কাজে সহায়তার আশ্বাস বাস্তবায়ন ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে গুজবের বাজা আবারও মার খেয়েছে। গত কিছুদিন ধরে কী গুজবকা-ই না ঘটেছে। সঙ্গে নানা অবান্তর কথামালা। তা চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর ভর করলেও গুমে জড়িত অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় ২৫ সেনা কর্মকর্তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এতে নতুন করে হিড়িক পড়ে।

সেনাবাহিনী বিচার করতে দিতে চায় না, এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বা আদালতের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চরম বিরোধ যাচ্ছে, যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, ভেতরে অবস্থা বড় গরম ইত্যাদি গুজবে দেশ গরম করে তোলা হয়। সেখানে ঠান্ডা পানির ছটা দিয়েছে সেনাবাহিনীই। জানিয়ে দিয়েছে, ‘নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ’। গুমের শিকার পরিবারগুলোকে গভীর সমবেদনাও প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইনকে মুখোমুখিও করেনি, বরং আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে সহায়তা দিচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর অভিযুক্তদের পরিবার থেকে আলাদা করে সেনা হেফাজতে এনে সেনাবাহিনী এ বিচারে সহায়তা করছে। জানানো হয়েছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। এটি কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। আরও জানান, ঘটনাকালে অভিযুক্তদের কেউই সেনাবাহিনীর সরাসরি কমান্ডের অধীনে কর্মরত ছিলেন না। ডিজিএফআই বা র‌্যাবে ছিলেন ডেপুটেশন বা প্রেষণে। এ বাহিনীগুলো সেনাবাহিনীর অধীনে নয়। বিশেষ করে ডিজিএফআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অভিযুক্তদের কর্মকা- সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডের বাইরে। তাদের সম্পর্কে সেনা সদরের পক্ষে অবগত হওয়া বা নজরদারি করার ব্যবস্থাই নেই। আর র‌্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

এ অবস্থায় গোটা সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি করার দুষ্টুচেষ্টা চলে। তবে, হালে পানি পায়নি। এর আপাতত একটা অবসান ঘটেছে। তাদেরকে ঢাকা সেনানিবাসের যে সাবজেলে রাখা হয়েছে, সেখানে এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। লীগ সরকারের আমলে গড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ সরকার আমলে তার অতীত একতরফা বিচারিক কলঙ্ক কাটিয়ে উঠেছে। কাউকে মনগড়া মৃত্যদ- বা বিচারিক হত্যাকা- ঘটানোর পথে নেই ট্রাইব্যুনাল। বিচারের আগেই বিচার করছে না। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। মন খুলে কথা বলছেন তাদের আইনজীবীরা।  ট্রাইব্যুনাল কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর এই সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সেনানিবাসের সাবজেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলায় যে ১৫ জন সেনা কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণকারীদের নির্দোষ বলে দাবি করেছেন তাদের আইনজীবী। বলেছেন, এই মামলার মূল অপরাধীরা ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জেনারেল কবির, জেনারেল আকবর, জেনারেল তারিক সিদ্দিকী, জেনারেল মুজিব। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের গুম-নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকা-ের ঘটনায় করা একটি মামলায় মোট ২৫ জন সাবেক-বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। সেদিনই এই তিন মামলায় ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৫ জন কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এই মামলাগুলোয় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি।

এর মধ্যে আল-মামুন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তিনি অ্যাপ্রুভার। স্বীকার করেছেন, যা কিছু হয়েছে, তা শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের নির্দেশে হয়েছে। এখানে কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। গণঅভ্যুত্থানে সেই সরকারের পতন পরবর্তীতে ওইসব ঘটনার বিচার এ সরকারের দায়িত্ব। সরকারের একারই দায়িত্ব এমনই নয়। সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতাসহ বিপ্লব সফলে সংশ্লিষ্ট সবাই এর অংশীজন। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের নজরও এদিকে। বিশেষ নজর বিচার প্রক্রিয়ার দিকে। ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রায়ালে আনার ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বলেছে, বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করার এটিই প্রথম উদাহরণ। ভুক্তভোগীদের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বিচারিক প্রক্রিয়াজুড়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদ- পুরোপুরি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে রয়েছে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা বিধান করা, বিচার কার্যক্রম বেসামরিক আদালতে পরিচালনা করা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা অনুসারে মৃত্যুদ- দেওয়া থেকে বিরত থাকা।

বিশ্বায়নের এ যুগে বিচারসহ কোনো দেশের ঘটনাবলির দিকে বিভিন্ন দেশেরই নজর থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের পর্যবেক্ষণ জোরদার করে। অ্যামনেস্টির প্রতিক্রিয়া এরই অংশ। এর  দুদিন আগে, আগে জুলাই বিপ্লব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছরেরও বেশি সময় পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইন সংস্কার শুরু করা এবং গুম ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তদন্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রশংসা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যৌথভাবে খোলাচিঠি দিয়েছে ৬টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। এতে স্বাক্ষরকারী সংস্থাগুলো হলো- সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ফর্টিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্চ এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট। চিঠিটি প্রকাশ হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এতে তারা ১২টি সুপারিশ আমলে নেওয়ার জন্য সরকারের উদ্দেশে তুলে ধরেছে। পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে। পাশাপাশি চলমান নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট যেসব মামলার যথাযথ প্রমাণ নেই বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়Ñ তা অবিলম্বে বন্ধের কথাও বলেছে।  নয় নম্বর প্রেসক্রিপশনে এসেছে আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে যে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও বহুদলীয় রাজনীতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। দশ, এগারো, বারো নম্বরে গিয়ে সিভিল সোসাইটি ও এনজিও স্বাধীনতাসহ আরও কিছু বিষয় আনা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কিছু গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকেই বেশি পিক করেছে। কেউ কেউ এক নম্বরেই নিয়ে এসেছে।  সরকার গোটা বিষয়টিকে সতর্কতার সঙ্গে নিয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যেও তা পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজ করবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের কাজ করবে। সরকারের পক্ষে কখনোই তাদের সবকিছু মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না।  মানবাধিকার নিয়ে কোনো উদ্বেগ এলে সেটাকে বিবেচনায়ও নেবে। ছয় সংস্থার চিঠি নিয়ে সরকার প্রতিবাদ বা বিবৃতিও দেবে না।