ক্ষমতায় গেলে নারীদের কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করা হবে সম্প্রতি এমন এক ঘোষণা এসেছে। কথাটা প্রথমে শুনলে অনেকের কাছে হয়তো ভালোই লাগতে পারে। কেউ বলবে, ‘দেখ, নারীর প্রতি কী সহানুভূতি!’ কিন্তু একটু গভীরে তাকালেই বোঝা যায়, এই কথার আড়ালে লুকিয়ে আছে বিপজ্জনক এক চিন্তাÑ নারীকে আবার ঘরে ফেরানোর, তাকে কর্মক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়ার এক নরম কৌশল।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করলে কি নারী আট ঘণ্টার সমান বেতন পাবেন? যদি উত্তর হয় হ্যাঁ, তাহলে শ্রমবাজারের বাস্তবচিত্র কী দাঁড়াবে? বেসরকারি খাতে মালিকেরা কি সমান বেতনে অর্ধেক সময় কাজ করা কর্মীকে রাখতে চাইবেন? তারা সহজেই বলবে, ‘একই বেতনে পুরুষ আট ঘণ্টা কাজ দিচ্ছে, তাহলে নারীকে কেন নেব?’ ফলাফল খুব সহজ। নারীদের জন্য চাকরির সুযোগ আরও কমে যাবে, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা হ্রাস পাবে, অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে অদক্ষ বা ‘অর্ধেক সময়ের কর্মী’ হিসেবে দেখবে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর যদি বলা হয়, পাঁচ ঘণ্টা কাজের জন্য বেতনও কমবে, তাহলে তো নারী আর্থিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে নারীকে ঘরে ফেরানো, তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সংকুচিত করা, তার পেশাগত অবস্থান দুর্বল করাÑ সবই অনিবার্য হয়ে উঠবে।
নারী অফিসে বা কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি নারী মানে ঘরেও আরেকটি পূর্ণ সময়ের দায়িত্ব। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসার, সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা, স্বামীর যতœÑ সবকিছুই তার সময়, পরিশ্রম ও মানসিক শক্তি দিয়ে টিকে থাকে। সেই নারীর জন্য যদি কর্মঘণ্টা কমানোর নামে তার আয় কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে পরিবারের ওপর। দিনে পাঁচ ঘণ্টা বাইরে কাজ, বাকি সময় ঘরে বিনা পয়সায় খাটুনি। এটাই কি তবে সেই ‘নারীবান্ধব’ নীতি? নারীকে যেন ঘরে আরও তিন ঘণ্টা বেশি কাজ করানো যায়, অথচ তার শ্রমের আর্থিক মূল্য না দিতে হয়Ñ এই নীতিটাই মূলত তেমন এক কৌশল।
নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন কখনোই কাজের সময় কমিয়ে আনা নয়; তার কাজের পরিবেশকে নিরাপদ ও সহায়ক করা উচিত। কর্মক্ষেত্রে শিশুসন্তানসহ নারীরা যেন নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন, সেজন্য চাইল্ড কেয়ার বা ডে কেয়ার সেন্টার থাকা জরুরি। নারীরা যেন অফিসে বা কারখানায় যাতায়াতের সময় হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, বেতনসহ ছুটি, স্বাস্থ্যবিমাÑ এসব ন্যূনতম অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হওয়া দরকার। আর কর্মক্ষেত্রে নারী যেন শুধু উপস্থিত থাকে না, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অংশ নেয়Ñ এই লক্ষ্যেই নেতৃত্বের জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
কিন্তু যেসব দল নারীর স্বাধীনতা ও কর্মজীবনকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে, তারা কখনোই এই বাস্তব সমাধানগুলোতে আগ্রহ দেখায় না। তারা নারীকে ঘরে রাখতেই চায়Ñ অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, সামাজিকভাবে নীরব এবং রাজনৈতিকভাবে অদৃশ্য এক অবস্থায়। তাদের চোখে নারী যেন এক ‘রক্ষা’ করার বস্তু, যার স্বাধীনতা নয়, শাসন দরকার। তাই তারা মাঝে মাঝে এমন ‘সহানুভূতির’ ভাষা ব্যবহার করে, যা আসলে শাসনের অন্যরূপ। কর্মঘণ্টা কমানো তারই উদাহরণ। এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে, নারী দুর্বল, নারী দীর্ঘ সময় কাজ করতে পারে না, তাকে ‘ছাড়’ দিতে হবে। অথচ সত্য হলোÑ নারী পুরুষের মতোই পরিশ্রমী, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ দায়িত্ব পালন করে।
এই ধরনের নীতির পেছনে রাজনৈতিক অভিপ্রায়ও স্পষ্ট। নারী যদি কর্মজীবন থেকে সরে আসে, তাহলে তার আর্থিক স্বাধীনতা হারায়। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মানুষ রাজনৈতিকভাবে নীরব হয়ে পড়ে। যারা সমাজে প্রশ্ন তোলে, অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করে, তারা সাধারণত নিজের শ্রমের মূল্য জানে, নিজের উপার্জনে আত্মমর্যাদা পায়। তাই নারীর কণ্ঠ রুদ্ধ করতে হলে, আগে তার আয়ের পথ রুদ্ধ করতে হয়। এই নীতিই সেটি করেÑ ‘সহানুভূতি’র নামে তাকে সমাজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পথ তৈরি করে।
বাংলাদেশে গত দুই দশকে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে, বিশেষত পোশাক শিল্প, ব্যাংক, মিডিয়া, প্রশাসন, এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রেও নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। এই পরিবর্তনই অনেকের চোখে আতঙ্কের কারণ। যারা মনে করে, নারীর জায়গা ঘর, তার জীবন শুধু পরিবার ও সন্তান ঘিরে, তারা এই অগ্রগতি মেনে নিতে পারে না। তাই নারীকে ঘরে ফেরানোর নতুন নতুন যুক্তি খোঁজা হয়। কখনো ধর্মের নামে, কখনো সংস্কৃতির নামে, কখনো আবার ‘নারীর সুরক্ষা’র নামে। বাস্তবে কিন্তু লক্ষ্য একটাই নারী যেন ঘরে থাকে, তার স্বাধীনতা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
জামায়াতুল মুজাহিদিন বা জামায়াত ইসলামীর মতো সংগঠনগুলোর অতীত আচরণই প্রমাণ করে, তারা নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। একসময় এই দল নারী শিক্ষার বিরোধিতা করেছে, মেয়েদের স্কুলে যাওয়াকে ‘অশালীনতা’ বলেছে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নারীর মর্যাদাহানি ঘটানোর মতো অপরাধেও যুক্ত ছিল। সেই একই চিন্তাধারা আজও বেঁচে আছে, শুধু ভাষা পাল্টেছে। এখন তারা বলে, ‘আমরা নারীর সম্মান রক্ষা করব’Ñ কিন্তু সেই সম্মান মানে আসলে তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, তার চলার পথ সংকুচিত করা।
নারী যদি কর্মক্ষেত্রে থাকে, নিজের উপার্জন করে, সিদ্ধান্ত নিতে শেখেÑ তাহলে সমাজের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায়, সেটাই তাদের ভয়। তাই তারা এমন নীতি প্রস্তাব করে, যা নারীকে নরমভাবে প্রান্তে ঠেলে দেয়। কর্মঘণ্টা কমানো সেই প্রান্তিককরণের আরেক রূপ।
এই মুহূর্তে আমাদের ভাবতে হবেÑ আমরা কি সত্যিই এমন এক দেশে ফিরে যেতে চাই, যেখানে নারী আবার ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি হবে? যেখানে তার কাজের সময় নির্ধারণ করবে পুরুষতান্ত্রিক নীতি? যেখানে তার বেতন, তার স্বাধীনতা, এমনকি তার কণ্ঠও সীমাবদ্ধ থাকবে?
নারীর জন্য প্রকৃত নীতি হবে সেই নীতি, যা তাকে সমান সুযোগ দেয়, তার কাজের মর্যাদা নিশ্চিত করে, তার নিরাপত্তা ও নেতৃত্বের পথ খুলে দেয়। নারীকে ‘দুর্বল’ হিসেবে নয়, ‘সমান নাগরিক’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই একটি সভ্য সমাজের পরিচায়ক।
আজ আমাদের দরকার সেই স্পষ্ট অবস্থানÑ নারীর নামে প্রতারণা নয়, প্রকৃত সমতা চাই।
যে দল নারীকে কেবল ঘরের মানুষ বানাতে চায়, নারীকে ভয় পায়, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়Ñ তাদের হাতে এই দেশ নিরাপদ নয়।
নারী মানে শ্রম, প্রজ্ঞা, আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক। তার সময় কমিয়ে নয়, তার সময়ের মর্যাদা দিয়ে এগোতে হবে। কর্মঘণ্টা কমিয়ে নারীকে বঞ্চিত করা নয়, বরং কাজের পরিবেশ বদলানোই হবে প্রকৃত ন্যায়।
জামায়াতের মতো দল ক্ষমতায় এলে নারী অধিকার, শিক্ষা, কর্মসংস্থানÑ সবই আবার পিছিয়ে যাবে। তাই এখনই সতর্ক হওয়ার সময়।
নারীর নামে যে শৃঙ্খল পরাতে চাওয়া হচ্ছে, তা যেন আরেকবার আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে না ঠেলে দেয়। নারীর সময় নয়, তার অধিকার কমানো যাবে না। নারীর নামে প্রতারণার এই রাজনীতি আমরা চিনে নিয়েছিÑ এই চিনেই আমাদের প্রতিরোধ গড়তে হবে।

