সুদান আফ্রিকার উত্তর‐উত্তরপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত দেশ। এই দেশটি একসময় শান্তির প্রতীক ছিল। ২০১১ সালের একটা ভাঙনের পরেও দেশটি আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের পতাকা ধরেছিল। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস (এসএফ) এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যেন পুরোনো ধারেই ছুড়ে ফেলা হয়। এই তুলনায় গৃহযুদ্ধ কেবল সেনা সংঘর্ষ নয়, এটি মানবিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক এক ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞে রূপ নিয়েছে। সে বিষয়ে আগে সচেতন না হলে দেখব কীভাবে সাধারণ মানুষ লন্ডভন্ড হয়ে পড়ছে।
দারফুরের সোনার খনি, উপকূলীয় লোহিত সাগর এলাকা, কৃষি ও তেল এই দেশটি একাধিক রিসোর্সে ভরপুর। আরএসএফের আগমন মূলত ২০০৩ সালে, দারফুর তথা উত্তর সুদানের ভেতরে। সে সময় তাদের নাম ছিল ‘জানজাওয়িদ’। এই যাযাবর সশস্ত্র দলকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে নামান্তর করে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস নামে এবং ২০১৭ সালে আইনগত মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে এ পদক্ষেপই ছিল জ্বরের উপসর্গ যা কেবল একটি সামরিক বাহিনীর আত্মপ্রকাশ নয়, ছিল একটি সামাজিক বিধ্বংসের সূচনা।
২০২১ সালের দিকে দীর্ঘদিনের যৌথ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে অধীনে থাকা বাহিনী বা স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল সেই দ্বন্দ্ব পূর্ণরূপ নেয় এবং রাজধানী খার্তুমসহ বিভিন্ন বড় শহরে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ যেন একটা ঘোর ফিরে এসেছে সুদানের মানুষ আবারও রক্তপাত-ভারি বিভাজনের গ্রাসে পড়েছে।
এই যুদ্ধের প্রভাব একেক দিকে বিস্তার লাভ করেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর একটি পরিমাপ হলোÑ ২০২৫ সালের মধ্যে একাধিক অঞ্চলে মানুষ আর তাদের জীবিকা হারিয়ে ফেলেছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, ২০২৫ সালে প্রায় ৩০.৪ মিলিয়ন মানুষ সাহায্যের অপেক্ষায়, যাদের মধ্যে ১৬ মিলিয়ন শিশুও রয়েছে। এই তথ্য শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিবার একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবার, একেকটি টুকরো জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে।
সুদানের গৃহযুদ্ধ দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদ- ভেঙে দিয়েছে। সংঘর্ষের কারণে বহু স্কুল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিংবা সামরিক বাহিনী দ্বারা দখল করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় ১ কোটি ৯০ লখেরও বেশি শিশু তাদের নিয়মিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা এক প্রজন্মব্যাপী সংকটের সৃষ্টি করছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, এই শিশুরা শুধু শিক্ষাই হারাচ্ছে না, তারা সহিংসতা, শিশুশ্রম ও নিয়োগের ঝুঁকিতেও রয়েছে। শিক্ষা সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতে সুদানের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভূমধ্যসাগর বা লোহিতসাগর নয়, এবার সুদান আফ্রিকার স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যায় দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুনের দিকে ৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, শরণার্থী হিসেবে। এই মানে শুধু সুদানের ভেতরে সংকট নেই এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক একটি বিস্তৃত বিপর্যয়।
সুদানের বর্তমান সংঘাত কেবল দুটি সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি ঐতিহাসিক জাতিগত ও আঞ্চলিক বিভাজনকে আবারও উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে, আরএসএফ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেকার পুরোনো সংঘাত নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অস্ত্র ও সংঘাতের মাধ্যমে এই জাতিগত মেরুকরণ সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি করছে, যা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও জাতীয় সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন করে তুলবে।
আর্থিক ক্ষতির কথা বললে কৃষি ও তেল-উৎপাদন যে ছিল দেশটির মূল চাকা, তা এখন থেমে গিয়েছে। শস্য উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, খাদ্যসংকট বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী। এই অবস্থা সাধারণ মানুষের জীবিকা ও প্রতিদিনের বেঁচে থাকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু দেশ নয়, এটি এক ধ্বংসপ্রবণ অর্থনৈতিক মডেলও দেখাচ্ছে যেখানে রপ্তানির ওপর নির্ভরতা একবিংশ শতাব্দীতে বিপরীতে কাজ করছে।
সুদানে খাদ্য নিরাপত্তার সংকটকে গৃহযুদ্ধ আরও বাড়িয়ে তুলেছে, কিন্তু এর মূলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা এবং মরুকরণ কৃষি উৎপাদনকে বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। সংঘাতের কারণে কৃষকরা তাদের জমিতে যেতে পারছে না এবং বীজ, সার বা সেচের মতো সহায়তাও পাচ্ছে না। এই দ্বিমুখী চাপ, জলবায়ুজনিত এবং যুদ্ধজনিত সুদানের মানুষকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও অবস্থার ভয়ংকরতা প্রকাশ পাচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে সুদানে সর্বনি¤œ ৩,৩৮৪ জন নারী-পুরুষ সহস্রাধিক সিভিলিয়ান নিহত হয়েছে। এছাড়া শিশু সৈনিক নিয়োগ, গণহত্যার অভিযোগ, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ হয়ে উঠেছে। একটি রাষ্ট্রীয় ধ্বংস-চিহ্নের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ পথ হারাচ্ছে।
সংঘাতে নারী ও মেয়েরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যৌন সহিংসতা, অপহরণ এবং জোরপূর্বক বিবাহের ঘটনা সাধারণ হয়ে উঠেছে। বাস্তুচ্যুত শিবিরের ভেতরেও তাদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব রয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে নারীর প্রতি এই সহিংসতা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি সামাজিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বেসামরিক প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালে বোমা, বাজারে ঢেউ, বিদ্যুৎপ্রণালি ধ্বংস এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৫ সালের মার্চে ইউনিসেফ প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে ১.২ মিলিয়ন শিশুকে শিক্ষা সুযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ৭৩৩ মিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘাটতি রয়ে গেছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় রোগ মহামারির ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে গেছে। হাসপাতালগুলোতে বোমা হামলা এবং চিকিৎসা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করায় স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। অপুষ্টি, অনিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশনের অভাবে কলেরা, হাম এবং ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
দারফুর শুধু ইতিহাসের অধ্যায় নয়, বর্তমান এই সংঘাতে অন্যতম বধ্যভূমি। বনদ্রোহিত এলাকা, গণকবর ও নিধন-অভিযোগ রয়েছে। অতি সম্প্রতি একটি খবর হলো অনধিকার আগ্রাসনে এল-ফাশেরে একটি হাসপাতালে হামলায় ৭০ জন নিহত হয়েছে। এটি শুধু সংখ্যা নয় মানুষের জীবনের বিনিময়ে লেখা এক অধ্যায়।
ভূরাজনৈতিকভাবে সুদান আজ ‘প্রক্সি যুদ্ধের’ ময়দান। উপসাগরীয় দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি এবং আফ্রিকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য এখানে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। ফলে সংঘাত শুধু অভ্যন্তরীণ রূপে সীমাবদ্ধ নেই; এটি এক ভারসাম্যহীন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে সুদানের সংকট সাধারণ মানুষের একান্ত নিরাপত্তার বিষয় নয় এটি বৃহত্তর পরিচালিত ধ্বংসের অংশ।
সুদানে প্রায় ১ কোটি ১০ লখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন (ওউচং), যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। তাদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছেন স্কুল, সরকারি ভবন বা উন্মুক্ত স্থানে, যেখানে মানবিক সহায়তার অভাব রয়েছে। রাজধানী খার্তুমের মতো শহরগুলোর যোগাযোগ, বিদ্যুৎ এবং জল সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণে যুদ্ধ শেষ হলেও পুনর্গঠন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া একটি বিশাল আর্থিক এবং প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলো শরণার্থীর বোঝা পাচ্ছে। যেমন মিসর বা দক্ষিণ সুদান এসব দেশে সুদানের পালিয়ে আসা মানুষজন আশ্রয় নিচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান প্রবাহ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলছে। আর এভাবেই সুদানের বিপর্যয় হয়ে উঠেছে এক বহির্বিশ্বীয় উদ্বেগের বিষয়।
প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলো এবং পার্শ্ববর্তী আফ্রিকান শক্তিগুলো নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করছে। এই বৈদেশিক হস্তক্ষেপ যুদ্ধকে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল করে তুলছে। আরএসএফ এবং এসএএফ উভয়েই বিদেশি অর্থ, অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা পাচ্ছে, যা তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। সুদানের জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে সকল বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জন্য কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা।
শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এখন প্রয়োজন কূটনৈতিক উদ্যোগ, শক্ত হাতে আইন প্রয়োগ, এবং মানবিক সহায়তার দ্রুত বর্ধন। কিন্তু পরিবেশ, রাজনৈতিক ঘোরাঘুরি ও অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ বা আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য শুধু দেখার বিষয় নয় এটি এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। যারা শান্তি বজায় রাখা চায়, তাদেরকে আগে দেখতে হবে কীভাবে সংঘর্ষ বিকাশ পায় এবং কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়।
সুদানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ওঈঈ) পূর্বে দারফুর সংঘাত নিয়ে তদন্ত শুরু করলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীদের জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ইউএন নিরাপত্তা পরিষদ (টঘঝঈ) এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর উচিত হবে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা।
সুদানের কাহিনি বলছে যুদ্ধ কোনো সিদ্ধান্তহীন ঘটনার সমষ্টি নয়, এটি পরিকল্পিত আদান-প্রদান, প্রতিযোগিতা, বল ও সম্পদের লড়াই। কখনো কখনো একমাত্র পথ শুধু বেঁচে থাকা, নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা।
সুদান যদি আজ সংকটে হয়, তাহলে শ্রবণশীল বিশ্বের দায়িত্ব আরও বড়। যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা, ও দেশে ফিরে‐শাসন প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় আন্তর্জাতিক ভূমিকা রাখা জরুরি। পার্বত্য আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য যেখানে শান্তি ধ্বংসের খেলা চলছে সেখানে সুদানের ভাগ্য শুধু একটি দেশের নয়, এক অঞ্চলের শক্তি ও মানবতার প্রতিফলন।
বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, সংঘাতের মূল কারণ জাতিগত বিভাজন নিরসন, এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই শান্তি ফেরানোর একমাত্র পথ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে শুধু মানবিক সাহায্য নয়, বরং রাজনৈতিক চাপ এবং কূটনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে দ্রুত যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা। সুদানের মানুষের জীবন রক্ষায় দ্রুত ও কার্যকর আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

