ঢাকা বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫

পলাতক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র রুখতে হবে

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৫, ০১:৩০ এএম

পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ কখনোই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। তারা অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করে গদিতে থাকার জন্য যা ইচ্ছা তাই করেছে। তাই তাদের বিদায়টাও মোটেই সম্মানজনক হয়নি। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এমন লজ্জাজনক বিদায় অতীতে কারোরই হয়নি। আর যারা এভাবে একবার বিদায় নিয়েছে তারা আর কখনোই দৃশ্যপটে ফিরে আসতে পারেনি বরং তাদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশের পতিত স্বৈরাচার আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং ঐক্যবদ্ধভাবে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ-বিভাজনের যেসব আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে স্বৈরাচারের দুর্নীতি ও গুম-খুনের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট থেকে পুরোনো গতানুগতিক বন্দোবস্তে ফিরে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, ভারতীয় হুমকি ও অপপ্রচার, নাশকতাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ধারাবাহিক তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ার বাস্তবতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীরা ছাত্র-জনতাকে আবারও রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, সংস্কার প্রশ্নে মতানৈক্য এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নানাবিধ বিচ্যুতি ও ব্যর্থতার কারণে জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে  চলেছে বলে মনে হচ্ছে।

জাতীয় নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে সবার। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সময়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, জুলাই জাতীয় সনদ। যারা জুলাই চেতনার পরিপন্থি কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে বাধা সৃষ্টি করবে তাদের জাতি ক্ষমা করবে না। জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি আমরা। অবশ্যই কারো দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করা এ সরকারের কাজ নয়। একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যথেষ্ট আন্তরিক এবং সিরিয়াস। তাদের বিগত কয়েক মাসের কর্ম তৎপরতা এটা প্রমাণ করে।

দেশ অস্থিতিশীল হলে পরাজিত, পলাতক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম হতে পারে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘গুপ্ত রাজনীতি’ সম্পর্কে সজাগ থাকাতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শান্তিকামী, সহনশীল, গণমুখী ধারা চালু করতে না পারলে চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন বিফলে যাবে। ভিন্ন দল ও মতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে সবাইকে, এটি একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। দেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই  সবাইকে নতুন ধারার রাজনীতির প্রচলনের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করতে হবে। স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট লুটেরা সন্ত্রাসী শক্তির কবল থেকে মুক্ত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে মিলে আওয়ামী ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে। দেশের মানুষ সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের আকাশে যে কালো মেঘ ছিল, তা কিছুটা সরে গেছে; কিন্তু আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি আবার সেই অন্ধকার ফিরে আসে, তবে আমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। নিজেদের নিরাপত্তা ও দেশের স্বার্থে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। 

সম্প্রতি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত পতিত স্বৈরাচার নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে দেশে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা আগামী ১৩ নভেম্বর দেশ অচল করে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারণের লক্ষ্যে লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে চরম স্পর্ধা দেখিয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করছেন  নিষিদ্ধ ঘোষিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কতিপয় পলাতক নেতা। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমাগতভাবে হুমকি দিয়ে চলছে দেশ অচল করে দেওয়ার। হঠাৎ করে পতিত স্বৈরাচারের পলাতক নেতাদের হুমকিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কি সেই দুঃসহ ভয়ঙ্কর আওয়ামী স্বৈরাচারী দুঃশাসন ফিরে আসছে দেশে? যখন দীর্ঘ সময়ব্যাপী আওয়ামী দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশ একটি অবাধ সুষ্ঠু সুন্দর নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সেই অপশক্তি দেশে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করেছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন ভ-ুল করতে তারা মাঠে নেমেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করে জনমনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর রেখেছে। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে তেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস নস্যাৎ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে সাফল্য দেখিয়েছে।

দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরে একটানা দুঃশাসনের দুঃসহ তিক্ত অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষ সহজে ভুলতে পারবে না। গুম খুন নিপীড়ন নির্যাতন অত্যাচার পৈশাচিকতার পাশাপাশি ব্যাংক লুট বিদেশে অর্থ পাচার, জালিয়াতি প্রতারণার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে পতিত স্বৈরাচারের মন্ত্রী ও নেতাকর্মীরা। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে দুর্নীতিবাজ, দলবাজ সরকারি আমলা, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদার কিছু সদস্য। তারা নিজেদের স্বার্থে আওয়ামী লীগের অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্মমতা সবকিছুকে  চোখ বুজে সমর্থন দিয়ে গেছে এবং প্রকারান্তরে সহযোগিতা করেছে। স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী, দুঃশাসনের খলনায়িকা শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান হলে তার সহযোগী অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে বিদেশে। অনেকেই আটক হয়ে কারাগারে গেছে। আবার দুর্নীতিবাজ দলবাজ সরকারি আমলাদের অনেককে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ এখনো সরকারের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত রয়েছে। যেখানে বসে তারা পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে তাদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে নানাভাবে ভূমিকা পালন করছে। পতিত স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্টদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সময় হাজার হাজার তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে নস্যাৎ করে দিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতারা এখন কী স্পর্ধা নিয়ে কথা বলছে! তাদের দুঃসাহস দেখে অবাক না হয়ে পারি না। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে, অনুশোচনা প্রকাশ না করে উল্টো ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থান সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করতে দ্বিধা সংকোচ করছে না। এখনো স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের নির্মমতার শিকার হয়ে প্রাণ হারানো হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর এবং বৃদ্ধ মানুষের রক্তের দাগ মুছে যায়নি। কান পাতলে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্বামীহারা বিধবা স্ত্রীদের, ছেলেহারা মেয়েহারা বাবা-মা ,ভাই-বোনদের আর্তনাদ শোনা যায়। চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার আগে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময়ে গুম খুন নিপীড়ন পৈশাচিকতার শিকার অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন বর্তমানে। এত এত অপকর্মের জন্য দায়ী গোষ্ঠীটি প্রতিবেশী একটি দেশের প্রত্যক্ষ মদতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠার হুমকি দিচ্ছে। বিদ্যমান শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামতে চাইছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ক্রান্তিকাল চলছে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ, অনৈক্য, সংঘাত সৃষ্টির আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সেই সুযোগে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসররা ষড়যন্ত্রের নতুন নতুন জাল বুনছে। এরই অংশ হিসেবে তারা আগামী ১৩ নভেম্বর লকডাউন ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। তেমন প্রেক্ষাপটে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই। নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ, পারস্পরিক বিভেদ, অনৈক্য ভুলে তাদের সকলকে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থান ঠেকাতে আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামার আহ্বান জানাচ্ছি। যেভাবে খুনি স্বৈরাচারী-স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে চব্বিশের জুলাই আগস্টে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন আবারও সেই পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করে দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে সর্বশক্তি নিয়ে সবাই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে মাঠে নামবেন, দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করছি। এখন চারদিকে ষড়যন্ত্রের আভাস দেখে ঘরে চুপচাপ নির্বিকার বসে থাকার সুযোগ নেই।

আসুন, সবাই মিলে দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের কবল থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। কোনোভাবেই যেন সেই পতিত স্বৈরাচার ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। তাদের পুনরুত্থান ঠেকাতে না পারলে অচিরেই দেশ আবার ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে, এটা উপলব্ধি করতে হবে সবাইকে।