‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ বলিউড বিভিন্ন ছবিতে এ শব্দটি শুনে উত্তেজনা কাজ করলেও বাস্তবে যেন তা ততটাই ভয়ংকর। আন্ডারওয়ার্ল্ড মানেই খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ও মানবপাচারের মতো ভয়ানক সব কর্মকা-। অথচ এই ভয়ংকর শব্দটাই ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
১৯৮০ শতকের শেষে যখন দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা তখনই রাজধানীতে তুষের আগুনের মতো জ্বলে উঠে আন্ডারওয়ার্ল্ড। যেন অবাক হবে, আজকের এই আলোকিত, উন্নয়ন রাজধানী ১৯৯০-২০০০ পর্যন্ত আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মূলক ৮০ দশকের শেষের দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের শক্তি বাড়ানোর জন্য পাড়া-মহল্লায় ছাত্রনেতা বা স্থানীয় প্রভাবশালী যুবকদের ব্যবহার করতে শুরু করে। এই যুবকরা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে আন্ডারওয়ার্ল্ডের লিডার।
এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাজ ছিল ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায়, খুন করা, মাদক প্রচার করা, অর্থাৎ সব মিলিয়ে শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য। আবার কখনো কখনো নির্বাচনের সময় ‘পোলিং বুথ দখল’ অথবা ‘বিরোধী প্রার্থীকে হুমকি’ দেওয়ার কাজে রাজনৈতিক নেতারা এদের ব্যবহার করত।
তৎকালীন পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ, ওয়ারী, উত্তরা, মিরপুর ইত্যাদি এলাকায় গড়ে ওঠে আলাদা আলাদা গ্যাং বা আন্ডারওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক।
এসবের জন্য রাজধানীর বাসিন্দারা অপহরণ ও খুনের ভয়ে দিন কাটাত। পরিবারগুলো শিশুদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পেত। তরুণদের মধ্যে মাদক ও অপরাধ প্রবণতাও অত্যাধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সর্বোপরি জনগণের ন্যায়বিচার থেকে আস্থা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে দমনের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে র্যাব (জঅই) গঠনের পর অনেক আন্ডারওয়ার্ল্ড নেতা ক্রসফায়ার হয়ে মারা যায় এবং অনেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মাধ্যমে পরিস্থিতি আসতে আসতে স্বাভাবিক হতে থাকে।
কিন্তু তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক বর্তমান রাজধানী যেন ওই ৯০ দশকের ঢাকার এক নতুন সংস্করণ।
কারণ ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঢাকা মহানগরীর অপরাধ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।গত ২০২৪-এর আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে অপরাধের ডেটা অ্যানালাইস করে দেখা যাচ্ছে যে, গত ১৫ মাসে দেশে ৫০০+ খুন, ৩০০+ডাকাতি, ১০৭০+ ছিনতাই, এবং এ বছর ৭০+ চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশে অপরাধ কোন লেভেলের বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আপনার ধারণাও বাইরে। এসবের পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। মূলত বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা, প্রশাসনিক ব্যর্থতাই এই অপরাধগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
৯০ দশকের সেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পুনরায় প্রত্যাবর্তনকে। ২০০১ সালে তালিকাভুক্ত ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আলোচিত সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ক্যাপ্টেন ইমনসহ অন্তত চারজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে আসে। এ ছাড়াও মোট ২৭ জন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী জামিন লাভ করার পর তাদের নামে নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছে, জামিনে মুক্তি প্রাপ্ত এসব সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য শুধু অর্থ উপার্জন নয় বরং আবার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা এবং বর্তমান চাঁদাবাজির মাধ্যমে তারা মার্কেট সিগন্যাল দিচ্ছে যে আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো ক্ষমতা কাঠামো ফিরে এসেছে, এবং ব্যবসায়ীরা দ্রুতই চাঁদা দিতে হবে।
সম্প্রতি এই সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই হটস্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মতিঝিল, বাড্ডা ও মহাখালী।
খেয়াল করে দেখুন, সেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেই প্রশাসনিক দুর্বলতা, সেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের লিডার, ঢাকার সেই রেড রোন, সেই অপরাধ বৃদ্ধি সব মিলিয়ে একই প্রেক্ষাপট শুধু সময়টাই আলাদা। এ যেন ইঙ্গিত দিয়ে যায়, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। আর এবার যেন ইতিহাস বলতে চাচ্ছে, ঢাকা আবার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দিক যাচ্ছে। জরুরি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিজের চোখেই দেখতে পারব।
লাবনী আক্তার, লোকপ্রশাসন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

