‘এই রুপালি গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে’Ñগিটারের ছয় তার ও উদাত্ত কণ্ঠে এ গান গেয়েছিলেন রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু। গানের কথার ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সাত বছর আগে ২০১৮ সালের এই দিনে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন জীবনের ওপারে। রেখে গেছেন বর্ণাঢ্য সংগীত জীবন। যেখানে রয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গান, জাদুকরি গিটারের সুর, আর তারুণ্যের জন্য সীমাহীন ভালোবাসা। আজ আইয়ুব বাচ্চুর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী।
যাদের হাত ধরে দেশীয় ব্যান্ডসংগীত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের একজন ছিলেন তিনি। রুপালি গিটার ফেলে চলে গেছেন সবার প্রিয় এবি বস, কিন্তু আজও তিনি প্রাণবন্ত হয়ে আছেন ভক্তদের হৃদয়ে। আছেন রোজকার চর্চায়।
বাংলা ব্যান্ডের জনপ্রিয় গায়ক আইয়ুব বাচ্চু জীবদ্দশার উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান, যেগুলো আজও সবুজ পাতার সতেজতা উপহার দেয়। আইয়ুব বাচ্চুর গান মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতকে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম অগ্রপথিক তিনি। যার গান শোনার জন্য সবাই থাকত ব্যাকুল। তার গিটারের ঝংকার ফেটে পড়ত মাঠ-স্টেডিয়াম।
আকাশে উড়াল দিতে চাওয়া মানুষটি ঠিকই আকাশে উড়াল দিয়েছে, মাত্র ছাপ্পান্নতেই। তবে রেখে গেছেনÑ‘চলো বদলে যাই, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘ফেরারি এই মনটা আমার’, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘হকার’, ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, ‘গতকাল রাতে’, ‘সেই তারা ভরা রাতে’, ‘মেয়ে তুমি কি দুঃখ চেন’, ‘সাড়ে তিন হাত মাটি’, ‘উড়াল দেব আকাশে’, ‘কতদিন দেখেনি দুচোখ’, ‘মনে আছে নাকি নাই’, ‘কার কাছে যাব’, ‘লোকজন কমে গেছে,’ ‘একটাই মন যখন তখন’, ‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে’, ‘মন চাইলে মন পাবে’ এমন অসংখ্য কালজয়ী গান।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। গানকে ভালোবেসে সংগীতজীবন শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। তার এক বছর পরেই ব্যান্ড জগতে পা রাখেন তিনি। ১৯৮০ সালে আইয়ুব বাচ্চু যোগ দেন সোলস ব্যান্ডে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি দলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালে তিনি লাভ রানস ব্লাইন্ড (এলআরবি) ব্যান্ডদল গঠন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দলটির সঙ্গেই প্রধান ভোকাল হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
তার প্রথম গাওয়া গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। আর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’। তবে গানের জগতে সফলতা পান তার দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ময়না’-এর মাধ্যমে। দীর্ঘ ৪০ বছরের ক্যারিয়ার জীবনে অসংখ্য গান ভক্তদের উপহার দিয়ে গেছেন তিনি। গায়কী জীবনে ১২টি ব্যান্ড, ১৬টি একক ও বহু মিশ্র অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছিল তার। ভক্তরা আইয়ুব বাচ্চুকে ভালোবেসে কখনো ‘এবি’আবার কখনো ‘বস’ বলে ডাকতেন।
প্রতিভার যদি অন্য কোনো নাম দেওয়া যায়, তাহলে সেটা আইয়ুব বাচ্চুই হবেন। ব্যান্ড সংগীতের সাম্রাজ্য আছে। তবে নেই চাকচিক্য। ফিকে হয়েছে দেয়ালের রং। কারণ, শারীরিকভাবে বেঁচে নেই গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। তবে সুরপিয়াসীদের মনে তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল। বেঁচে থাকবে তার কথা, সুর ও কণ্ঠ। আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে তৈরি হয়েছে রুপালি গিটারের ভাস্কর্য। দূর থেকে সেই ভাস্কর্য দেখে মনে হবে আইয়ুব বাচ্চু আছেন, থাকবেন। তার সুরের মৃত্যু নেই। কণ্ঠের মৃত্যু নেই। দূরে, বহুদূরে চলে গেলেও সৃষ্টিশীল কর্ম এবং ভক্তদের ভালোবাসার মাঝেই বেঁচে থাকবেন এই গিটারের জাদুকর।