কাগজে-কলমে তাদের কর্মস্থল ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার পদে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে সংযুক্তির (প্রেষণ) নামে চারজন কাজ করছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। আর একজন গত ১১ বছর ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। এমন যখন অবস্থা তখন ১৭ জনের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক দিয়ে কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে নান্দাইলের ৫০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
এ অবস্থায় সংযুক্তিতে থাকা চিকিৎসকরা পদ আগলে রাখায় নতুন কেউ যোগদানও করতে পারছেন না। এতে কর্মস্থলে থেকে ওই পদের কারও কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারছে না সেবাপ্রত্যাশী রোগীরা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭টি মেডিকেল অফিসারের (এমও) পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র তিনজন। অন্যদিকে, কনসালটেন্টের ১০টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র চারজন। এদিকে হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক নিজেদের পছন্দমতো কর্মক্ষেত্রে প্রেষণে নিযুক্ত হয়েছেন। আরও একজন চিকিৎসক গত ১১ বছর ধরে অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। হাসপাতালটির চিকিৎসক সংকট চরমে উঠেছে। এ কারণে উপজেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসকের শূন্যপদগুলো পূরণ না হওয়ায় সেবা নিতে আসা রোগীরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা গেছে, নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রেষণে নিযুক্ত চিকিৎসকদের কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না হলে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নান্দাইল উপজেলার লোক সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। প্রতিদিন গড়ে জরুরি ও বহির্বিভাগে প্রায় ১ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। হাসপাতালে কর্মরত স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হাসপাতালের দাপ্তরিক সূত্র জানায়, সহকারী সার্জন ডা. হুরুল জান্নাত ২০২২ সালের ৩ মার্চ থেকে সংযুক্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায়। ডা. শারমিন মেছের সুরমা ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে সংযুক্তিতে রয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। ডা. উম্মে সালমা দিনা ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি ও ডা. দেবশ্রী দেবনাথ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে সংযুক্তিতে রয়েছেন থেকে রয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ফলে শূন্য পড়ে রয়েছে তাদের পদগুলো। ওই চারজন কর্মস্থলে যোগ দিয়েই কেউ দুই দিন কেউবা এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রেষণে নিজ কর্মস্থল ছেড়ে তাদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করছেন। অথচ প্রতি মাসে বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন নান্দাইল থেকে।
অন্যদিকে ডা. অনুজা রায় বনি নামে একজন চিকিৎসক ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। গত ১১ বছর তার কোনো খোঁজ নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছে না। তারা শুধু একাধিক চিঠি দেখিয়েছেন, যেগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ চিকিৎসকের পদ শূন্য হয়নি। ফলে চিকিৎসকের যেমন খোঁজ মিলছে না, তেমনি পদ খালি না হওয়ায় ওই পদে কেউ যোগ দিতে পারছেন না।
সম্পতি হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ, বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ ঘুরে রোগীদের প্রচ- ভিড় দেখা গেছে। শয্যাসংকটে আন্তঃবিভাগের বারান্দায় বিছানা পেতে থাকছে চিকিৎসাধীন রোগীরা। নারী, শিশু ও পুরুষ ওয়ার্ডের সব শয্যা রোগীতে পরিপূর্ণ। প্রসূতি ওয়ার্ডেও রোগী ভর্তি রয়েছে। যে কজন চিকিৎসক হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন, বহির্বিভাগে থাকা তাদের কক্ষগুলো রোগীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। কর্মরত চিকিৎসকরা পালা করে সব বিভাগের চিকিৎসাসেবা সামাল দিচ্ছেন।
নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শামীমা সুলতানা জানান, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। অন্তঃবিভাগে গড়ে ১২০ জন রোগী ভর্তি থাকে। জরুরি বিভাগে গড়ে প্রতিদিন ২০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। স্বল্প সংখ্যক চিকিসৎক দিয়ে চিকিৎসাসেবা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতালে আরও চিকিৎকের প্রয়োজন। এ কারণে প্রেষণে থাকা চিকিৎসকদের সংযুক্তি বাতিল করে তাদের মূল কর্মস্থলে ফেরত পাঠানোর জন্য এবং চিকিৎসক চেয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সাড়া পাচ্ছি না।
ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক পদায়নের জন্য কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে অবগত করা হয়েছে। চার চিকিৎসকের সংযুক্তির আদেশ বাতিল করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।