পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে আকস্মিক বন্যায় মৃতের সংখ্যা ৩২৮ ছাড়িয়েছে। প্রদেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (পিডিএমএ) জানিয়েছে, গত ৪৮ ঘণ্টায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩৪৪ জনে পৌঁছেছে এবং ২৩ জন আহত হয়েছেন।
বুনের জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে ১৮৪ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে বেশন্ত্রি গ্রামের মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল সামাদের গল্পটি বিশেষভাবে মর্মস্পর্শী।
বন্যার খবর পেয়ে তিনি তার পরিবারকে দ্রুত বাড়ি খালি করার নির্দেশ দেন, যখন তিনি নিজে নফল নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে ফিরে এসে তিনি দেখেন, পানির তোড়ে তার বাড়িসহ গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর ভেসে গেছে। এই ঘটনায় তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
কেয়ামতের দৃশ্য বেশন্ত্রি গ্রামে
বুনের জেলার পীর বাবা সাহেব উপজেলার অন্তর্গত বেশন্ত্রি গ্রামটি এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে মানুষের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য মতো কেউ ছিল না। এসব কাজে পাশের গ্রামের মানুষদের সাহায্যে করতে হয়েছে।
ইসলামাবাদে থাকা উপজেলার সাবেক কর্মকর্তা আশফাক আহমদ যখন বন্যার খবর পান, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি গ্রামে ফিরে এসে দেখেন এক ধ্বংসস্তূপ। তার বাড়িসহ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িই ধ্বংস হয়ে গেছে।
আশফাক আহমদের বাড়িতে থাকা ১৪ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, বাকি ১০ জন এখনও নিখোঁজ। গ্রামের আরেক পরিবারের ভাগ্য আরও করুণ; বন্যার সময় গাছে চড়ে দুই শিশু প্রাণে বাঁচলেও তাদের পরিবারের বাকি নয়জন সদস্য নিখোঁজ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নূর ইসলাম এবং মুহাম্মদ ইসলাম পাশের গ্রাম থেকে এসে উদ্ধারকাজে সহায়তা করেন। নূর ইসলাম জানান, ‘আমি দুপুর ১টার দিকে বেশন্ত্রি গ্রামে পৌঁছাই। তখন সেখানে একটা বাড়িও অক্ষত ছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ আমি নিজে ছয়টি কবর খননে সাহায্য করেছি এবং অসংখ্য জানাজায় অংশ নিয়েছি।’
মুহাম্মদ ইসলাম যখন গ্রামে পৌঁছান, তখন পুরো গ্রামকে তার কাছে ‘মৃত্যুপুরি’ বলে মনে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘সেখানকার সব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মরদেহ রাখার মতো কোনো উপযুক্ত জায়গাও ছিল না।’
সরকারি তথ্য ও উদ্ধার অভিযান
প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (পিডিএমএ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ২৭৯ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী এবং ১৩ জন শিশু রয়েছে। আহতদের মধ্যে ১৭ জন পুরুষ, চারজন নারী এবং দুইজন শিশু। বন্যায় এখন পর্যন্ত ৭৪টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩টি আংশিক এবং ১১টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
বুনের ছাড়াও সোয়াত, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাঙলা এবং বটগ্রামের মতো জেলাগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজাউর এবং বটগ্রামকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
উদ্ধার অভিযান জোরদার করতে খাইবার পাখতুনখোয়া সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং ফ্রন্টিয়ার কর্পসও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে, এবং দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে রাতের অন্ধকার, দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রাদেশিক সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে বুনের জেলার জন্য ১৫ কোটি এবং বাজাউর, বটগ্রাম ও মানসেহরার জন্য ১০ কোটি করে টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
‘মেঘ ভাঙা’ বৃষ্টি এবং আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের আকস্মিক বন্যার জন্য ‘ক্লাউড বার্স্ট’ বা মেঘ ভাঙা বৃষ্টিকে দায়ী করছেন। আবহাওয়া বিভাগের মতে, যদি একটি ছোট এলাকায় এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাত হয়, তখন তাকে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি বলা হয়।
আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এই ভারী বৃষ্টিপাত ২১ আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। পিডিএমএ পর্যটকদের আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে।
সূত্র: বিবিসি, জিও নিউজ, দ্য ডন