আফ্রিকার শিং অঞ্চলে আবারও যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে। ইরিত্রিয়ার রাজধানী আসমারা ও অন্যান্য শহরে সম্প্রতি নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে, যেখানে পুরুষদের অবিলম্বে স্থানীয় প্রশাসনে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেনারা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে তরুণদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য।
অন্যদিকে, সীমান্তের ওপারে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আবারও সমুদ্রপথের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ইথিওপিয়ার ভাগ্য সমুদ্রপথ দাবী করে।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান বিরহানু জুলা আরও বলেন, ‘১৩০ মিলিয়ন মানুষের দেশের ভাগ্য ২ মিলিয়নের হাতে থাকতে পারে না।’
উল্লেখ্য, ইথিওপিয়ার জনসংখ্যা অনেক বেশি, ইরিত্রিয়ার জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
ইরিত্রিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত আসাব বন্দর ইথিওপিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি উভয় দেশের কৌশলগত স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ইথিওপিয়া মনে করে, সমুদ্রপথ পুনরুদ্ধারের জন্য আসাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরিত্রিয়া মনে করে, বন্দর হারালে রাষ্ট্রপতি ইসাইয়াস আফওয়ারকির অজেয়তার ভাবমূর্তি ভেঙে পড়বে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।
ইতালীয় উপনিবেশ হিসেবে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন পর্যায়ের শাসন ও একত্রীকরণ–ভাঙনের মধ্য দিয়ে ইরিত্রিয়া ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। ইথিওপিয়া–ইরিত্রিয়া সম্পর্ক ১৯৯৮–২০০০ সালের সীমান্ত যুদ্ধের পর দীর্ঘ দুই দশক উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ২০১৮ সালে আবি আহমেদ ক্ষমতায় এসে ইসাইয়াসের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেন। পতাকা উড়ে, দূতাবাস খোলে—অঞ্চলে আশাবাদের জন্ম হয়। কিন্তু দুই বছর পরই দুই দেশ গোপনে টাইগ্রের বিরুদ্ধে যৌথ যুদ্ধ শুরু করে, যা ২০২২ সালের প্রিটোরিয়া চুক্তিতে শেষ হয়।
ইথিওপিয়ার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নিউ লাইনস-কে বলেন, ‘আবি এবং ইসাইয়াস দু’জনেই যুদ্ধ চাই, কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতাই তাদের আটকে রাখছে।’
তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী—আমহারা ও ওরোমিয়া অঞ্চলে বিদ্রোহের কারণে দেশ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত; আরেকটি যুদ্ধ দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়াবে; এবং লোহিত সাগরে সৌদি, মিশর ও আমিরাতের মতো শক্তির উপস্থিতি ইথিওপিয়াকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইথিওপিয়ায় দারিদ্র্য ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ, খরা ও সামরিক ব্যয় দেশকে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
অন্যদিকে ইরিত্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে অনির্দিষ্টকালের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা বজায় রেখেছে। দেশটিতে দমন–পীড়ন বাড়ছে, আর বিপুল সংখ্যক তরুণ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। নাইরোবিতে ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ে দেখা ১৭ বছরের হাবতে বলেন, ‘সৈন্যরা আসার আগে আমাকে চলে যেতে হবে। কারণ আমার বড় ভাই বাধ্যতামূলক সেনাসেবায় যোগ দিয়ে নিখোঁজ।’
এক প্রাক্তন রিক্রুট বলেন, এখন আরও কমবয়সীদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হচ্ছে, আর বয়স্ক সৈনিকদের পুনরায় ডাকা হচ্ছে। পশ্চিমা কূটনীতিকদের মতে, ইরিত্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
ইরিত্রিয়া বহু বছর ধরে আফার দল, সুদানি মিলিশিয়া এবং নির্বাসিত ইথিওপীয়দের প্রক্সি বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। একজন প্রাক্তন ইরিত্রিয়ান সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘ইসাইয়াস চান সবাই যেন আগুনে পুড়ে; তাতে তিনি নিরাপদে ঘুমান।’
টিগ্রেতে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একই সঙ্গে আফার অঞ্চলে টিপিএলএফের সঙ্গে সংঘাত বাড়ছে। উভয় পক্ষই একে অপরকে সীমান্ত লঙ্ঘন ও ড্রোন হামলার অভিযোগ করছে।
সুদানে এসএএফ–আরএসএফ যুদ্ধ পূর্ব সুদানকে মিলিশিয়া নিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছে, যা ইথিওপিয়া–ইরিত্রিয়া সীমান্তে অস্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে। এদিকে আল-ফাশাগা বিরোধও অমীমাংসিত রয়ে গেছে, যা আমহারা অঞ্চলে ক্ষোভ বাড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভুল হিসাব দ্রুত আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নিতে পারে। আসাবকে কেন্দ্র করে যেকোনো সংঘর্ষ শিপিং লেন, খাদ্য আমদানির রুট ও বীমা বাজারকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
কূটনীতিকরা বলছেন, ‘প্রবেশাধিকার আলোচনাযোগ্য; সার্বভৌমত্ব নয়। বিরোধকে কাঠামোগত আলোচনার মাধ্যমে হিমায়িত করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত আলোচনায় না বসলে যেকোনো সময় যুদ্ধের মতো একটি ঘটনা ঘটতে পারে। তাদের মতে, দ্রুত সময়ের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত। সেগুলো হলো— আসাব করিডোরে নো-স্ট্রাইক জোন, সেনা গতিবিধির নোটিফিকেশন, পর্যবেক্ষণ হটলাইন, প্রক্সি সহযোগিতা হ্রাস, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিষয় নিয়ে দ্রুত আলোচনায় বসলে উত্তেজনা হয়তো কমতে পারে।




