ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫

অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে হাসপাতাল

নাঈম শাহ, নীলফামারী
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৫, ০১:৫৩ এএম

নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর জোড়াতালি দিয়ে চলছে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। রোগীরা জায়গা না পেয়ে থাকছে করিডরের মেঝেতে। নতুন ভবনে খালি শয্যা থাকলেও রোগীরা পুরোনো ভবনে এক শয্যায় তিন থেকে চারজন বা মেঝেতে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছে। এদিকে হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও ১০০ শয্যারও কম জনবল দিয়ে চলছে, যার ফলে রোগী অনুপাতে পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

জানা যায়, ২০১৭ সালে সদর জেনারেল হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এরপর ২০১১ সালে শুরু হওয়া ৬তলা নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ৩০ কোটি ৯ লাখ টাকা, পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু নির্মাণ শেষের ছয় বছর পরও ভবনের অধিকাংশ অংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনটি চালুর আগেই দরজা-জানালা ভেঙে পড়েছে। কোথাও কোথাও উঠে গেছে টাইলস। অবহেলায়-অযতেœ পড়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের সরঞ্জাম, মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ওষুধ।

চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, নোংরা-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এক রুমে ১০ থেকে ১২ জন রোগীকে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। অথচ নতুন ভবনে শয্যা থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যবহার করা হচ্ছে না, তার জবাব পাচ্ছে না কেউ। হাসপাতালের এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগীরা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

আফিয়া বেগম বলেন, ‘বড় বড় বিল্ডিং আছে হাসপাতালে। কিন্তু ভালো চিকিৎসা নেই। এত বড় হাসপাতালে আমাদের মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। এত মানুষের ভিড়ে আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমরা বেশি করে অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’

আব্দুর রহিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ডাক্তার সময়মতো আমাদের দেখতে আসে না। ডাক্তারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সামান্য দুইটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের জন্য হাসপাতালের ধুলোভর্তি মেঝেতে দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে।’

আমিনা খাতুন বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে বারান্দায় শুয়ে আছি। ধুলোবালু ও ড্রেনের পচা গন্ধে থাকা দায় হয়ে উঠেছে। নতুন ভবনে খালি বেড থাকলেও সেখানে ভর্তি নিচ্ছে না। হাসপাতালের খাবারের মানও ভালো নয়। শুধু তেল আর হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করা খাবার।’

সিনিয়র স্টাফ নার্স শতাব্দী রানী রায় বলেন, ‘রোগীর চাপ সামাল দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত শয্যা নেই । চিকিৎসক ও সাপোর্ট স্টাফ নেই। অল্প জনবল নিয়ে এত রোগী সামলানো সম্ভব না। যাদের আইসোলেশন বা বিশেষ সেবা দরকার, তাদেরও সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

স্থানীয়রা জানান, জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষের একমাত্র ভরসা এই হাসপাতাল। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় বহন করতে পারে না। তাই সরকারি হাসপাতালই তাদের শেষ ভরসাস্থল। কিন্তু এখানে এসে নোংরা, ভিড়, অব্যবস্থাপনা আর শয্যাসংকটে বিপাকে পড়ে তারা। হাসপাতালের নতুন ভবন চালু না হওয়া যেন সাধারণ মানুষের জন্য ‘আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ’। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক ভবন অব্যবহৃত পড়ে থাকছে অথচ রোগীরা পুরোনো ভবনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কষ্ট পাচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই যথেষ্ট নয়; প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনাই এ ধরনের সংকটের মূল কারণ। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের আস্থা হারাবে জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলো।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবু-আল-হাজ্জাজ জানিয়েছেন, ‘নতুন ভবনে লিফট স্থাপনের কাজ শেষ হলে আগামী মাসে সেখানে সেবা চালু করা হবে। এতে পুরোনো ভবনে রোগীর চাপ অনেকটাই কমে আসবে এবং রোগীদের আর মেঝেতে থাকতে হবে না।’